পর্যটক মহলের অতি জনপ্রিয় জায়গা রাজস্থান। রাজস্থান বললেই আমাদের মনে পড়ে স্থাপত্য, মরুভূমি, নানা রঙের পোশাক, লোকায়ত গান, নাচ, রাজস্থানী খাদ্য আর কলসি ভরে জল নিয়ে যাওয়া রাজস্থানী মহিলা। রঙিন ঘাঘরা লোটানো এই মহিলাদের খিলখিল হাসির ছটায় মাত হয়ে যায় পর্যটকরা। কিন্তু এই হাসির আড়ালে কি লুকিয়ে আছে আলোয় ঝলমলে মরুভূমির কোনো অন্ধকার দিক? সমগ্র ভারতবর্ষের মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার নিরিখে সবথেকে বেশি পিছিয়ে রাজস্থান। গোটা রাজ্যের মাত্র ৫৭% মহিলা লিখতে পড়তে জানেন। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে যেন এক জাদুকরের মতো এলেন সিআইটিটিএ নামক এক সংস্থার কর্ণধার মাইকেল ডব।
মুকুল যেখানে তার সোনার কেল্লা খুঁজে পেয়েছিলো মাইকেলও সেই জয়সলমীরকেই বেছে নিয়েছেন তাঁর সোনার বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য। রাজস্থানী মেয়েদের সম্পূর্ণ বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে মাইকেল তাঁর ঝুলি থেকে বের করে আনলেন রাজকুমারী রত্নাবতী স্কুল। শুধু অবৈতনিকই নয়, ছাত্রীদের ইউনিফর্ম, লেখাপড়ার জন্য বই খাতা, দুপুরের খাবার এবং বাড়ি থেকে তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থাও স্কুল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে প্রদান করছে।
মরুভূমির বুকে এই ছোট্ট বিদ্যালয় ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে শুধু তার অভিনব কাজের জন্যই নয় অভিনব গঠনের জন্যও বটে। ডিম্বাকৃত এই স্কুলটি ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পেরও এক অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। অসামান্য দেখতে এই বিদ্যালয়টি সেই একই পাথর দিয়ে গড়া যা দিয়ে তৈরি হয়েছিল মুকুলের সোনার কেল্লা। এই পাথরের ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক ভাবে বিদ্যালয়টি থাকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। তাছাড়া বিদ্যালয়ের ছাদ জুড়ে বসানো হয়েছে সোলার সিস্টেম। মাইকেল ডব যে বিদ্যালয়টির স্বপ্ন দেখেছিলেন তাকে স্থাপত্যকর্মের এক অন্যতম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন ডিয়ানা কেলগ। কিন্তু কেলগ যে নকশা নির্মাণ করলেন তাকে বাস্তবে রূপদান করবে কে? এমন ইস্কুল বানানো কি চাট্টিখানি কথা? বেশিরভাগ স্থানীয় নির্মাতারাই এ কাজ নিতে অস্বীকার করলেন।
শেষ পর্যন্ত করিম খান এই অসম্ভবকে সম্ভব করে হাজির করলেন সকলের সামনে। এছাড়া এই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য পোশাক ডিজাইন করেন সব্যসাচী মুখার্জি। স্থানীয় মানুষেরাও এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানবেন্দ্র সিং শেখাওয়াত। মানবেন্দ্র এই বিদ্যালয়ের জমিটি স্কুল কর্তৃপক্ষকে দান করেছেন। জমি দানের সময় শুধু তার একটাই শর্ত ছিল। ওই জমির দুটি সবুজ গাছকে তিনি কাটতে নিষেধ করেছিলেন। ওই দুটি গাছকে মাঝে রেখেই গড়ে উঠেছে স্কুল। প্রজাপতির মতো বাচ্চারা এখন খেলা করে গাছ দুটির সাথে। প্রসঙ্গত বলা দরকার এই স্কুল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত (যাদের নাম উপরে উল্লেখ করা হল এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ) প্রতিটি ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে এই কাজে এগিয়ে এসেছেন। শিশু শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট চারশো বিদ্যার্থী এখন পড়াশোনা করছে এখানে। সর্বোপরি রাজস্থানী নারীদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর যে অঙ্গীকার তিনি গ্রহণ করেছেন তা কুর্ণিশ যোগ্য।
Discussion about this post