ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাবো গোটা পৃথিবীতেই বহু নারী তথাকথিত সমাজের প্রাচীর ভেঙে এক একটি অনন্য উদাহরণ রেখে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমনই একজন বীরাঙ্গনা নারীর কথা বলবো আজ। তিনি হলেন লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো, সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন মহিলা স্নাইপার। যিনি প্রায় একাই শত্রু পক্ষের হাড় হিম করে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানরা ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। তবে তারা জানত না এক নারী প্রায় ৩০৯ জন জার্মান সৈনিকদের একাই কুপোকাৎ করে দিতে সক্ষম। লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো যেন রণচণ্ডী রূপে অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্যই। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই স্নাইপার সেদিন জার্মানদের মধ্যে ৩৬ জন স্নাইপারকে একা নিজের হাতে শেষ করেন। তাই জার্মানদের মাঝে লুডমিলা ‘ডেথ লেডি’ নামে পরিচিত ছিলেন।
স্কুল জীবন থেকেই লুডমিলার খেলাধুলোর প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। আর খেলাধুলোর হাত ধরেই তার শার্প শুটিং প্রশিক্ষণের শুরু। এরপরে স্কুল জীবনের গণ্ডি পার করে লুডমিলা কিয়েভ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস নিয়ে পড়তে যান। এই সময় ১৯৪১ সালে জার্মানদের আক্রমণে কিয়েভের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার বিশ্ববিদ্যালয়টিও। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত বহু তরুণ যুবক যোগ দেয় সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও নিজের দক্ষতার প্রতি গভীর আস্থা রেখে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো যোগ দিতে চাইলেন সেনাবাহিনীতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তার আবেদনে সবাই গুরুত্ব না দিয়ে তাতে হাস্যকৌতুক খুঁজে পেলেন। লুডোমিলা তার শার্প শুটিং-এর সার্টিফিকেটও দেন তার আবেদন পত্রের সাথে। একজন নারীর এই রকম সাহসিকতায় সবারই সন্দেহ ছিল। সেনাবাহিনী থেকে তাকে এও বলা হয় যে সে সেনাবাহিনীতে কেবল নার্স হিসাবে যোগ দিতেই পারে।
যদিও লুডমিলাকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে কেউ সরাতে পারেন নি। অবশেষে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর ২৫ তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনে নিয়োগ করা হয় লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোকে। যুদ্ধের সময়ে বেলায়েভকা নামক গ্রামের কাছে একটি পাহাড়ে তাঁকে ও তার কিছু দক্ষ স্নাইপার সহকর্মীদের লুকিয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এইসময় সঠিক পজিশনে না থাকার ফলে লুডমিলার সহকর্মীর প্রাণ কেড়ে নেয় জার্মান সেনারা। এই দৃশ্য দেখে লুডমিলা নিজেকে আটকে রাখতে পারেন নি। প্রতিশোধের আগুন ও মাতৃভুমিকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা জাঁকিয়ে বসে লুডমিলার গরম রক্তে। শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু করেন সোভিয়েত বীরাঙ্গনা। স্নাইপারে লক্ষ্যভেদ করে কেড়ে নিতে থাকেন একের পর এক জার্মান সেনার প্রাণ। এভাবেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং প্রথম লেডি স্নাইপারের যাত্রা শুরু হয় নিজের স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণের দিকে।
পরবর্তীকালে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর অনেক কঠিন দায়িত্বেও তাকে নিযুক্ত করা হয়। রেড আর্মিতে তাঁকে দেখে দেশের প্রায় ২০০০ নারী সেনাবাহিনীতে স্নাইপার প্রশিক্ষণে যোগ দেয়। তাকে অর্ডার অফ লেনিনেও ভূষিত করা হয়৷ পরে তাকে রেড আর্মির স্নাইপিং পরামর্শদাতা হিসেবেই নিয়োগ করা হয়। নারীশক্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোর মতো সাহসী বীরাঙ্গনারা। সমাজের প্রত্যেকটা বাধা বিপত্তিকে কাটিয়ে যারা দৃঢ় সংকল্প থেকেছে নিজেদের লক্ষ্যে। রণক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে এই নিজের বীরত্বের এক বিশাল উদাহরণ রেখে গেছেন লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো।
তথ্য ঋণ – সংঘমিত্রা প্রধান রায়
Discussion about this post