স্বপ্নাদেশ মিলেছে, বাড়ির ছোটবউ নাকি দেবী! তাই এবারে ওই মেয়েটিকেই পুজো করবেন সবাই! আদেশমাত্রই, অন্দরমহল থেকে টেনে বের করে এনে সেই মেয়েকে বসিয়ে দেওয়া হলো সকলের সামনে, দেবীরূপে। আর এই অন্ধ দেবীত্বেই তছনছ হয়ে গেলো মেয়েটির জীবন। লেখক প্রভাতকুমারের গল্প অবলম্বনে ‘দেবী’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তবে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলে, যেখানে তিনি বাহবা কুড়োতে পারতেন, সেখানেই তাকে শুনতে হলো কটাক্ষ। নিজের ধর্মপরিচয় ব্রাহ্ম বলেই নাকি তিনি হিন্দু-ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাত হেনেছেন। নিজের সিনেমাজীবনে একাধিকবার এহেন অভিযোগের শিকার সত্যজিৎ। কখনও অভিযোগ ‘দেবী’ ছবি ঘিরে আবার কখনও ‘জয় বাবা ফেলুনাথে’র আইকনিক ‘মছলি বাবা’ চরিত্রটি নিয়ে।
তবে, এইসব বিতর্ককে কোনোদিনই কানে তোলেননি সত্যজিৎ। বরং সব সময়েই ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তার ছবিগুলি। শেষ বয়সে এসে একটি সাক্ষাৎকারেও সপাটে এইসব অভিযোগ খন্ডন করেছিলেন সত্যজিৎ। তিনি বলেন, “ধর্ম নিয়ে ভারতে এরকম দোষারোপের পালা চলতেই থাকে। বিশেষত হিন্দি সিনেমা দেখতে যারা পছন্দ করেন, যারা বিশ্ব সিনেমার সঙ্গে ততটা ভালোভাবে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি, তাদের জন্য আমার সিনেমা নয়। নিজেকে সবজান্তা ভাবলেও, এরাই কিন্তু আসলে বোকা। এরা সবাই পিছিয়ে পড়া দর্শক। এনারা বলিউডের সিনেমার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন যে তারা ভালো ও মন্দের বিচার হারিয়ে ফেলেছেন। তাই সত্যি কথা বলতে গেলে, তাদের কথা কিংবা তাদের মন্তব্যকে কোনোদিনই বিশেষ গুরুত্ব দিইনা আমি। বরং, আমি সেই সিনেমাই বানাই যেগুলো আমার ভালোলাগে।”
সত্যজিতের কাছে সিনেমা শুধুমাত্র পেশা ছিলনা, ছিল নিজের চিন্তা-চেতনাকে প্রকাশ করার একটা মাধ্যম। ধর্ম হোক বা রাজনীতি, গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী না হলেও, হিন্দু ধর্মবোধের প্রতি কোনোদিনই বিরাগ ছিলনা সত্যজিতের। এই কারণেই হয়তো যেখানে তিনি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ কিংবা ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এর মত কাহিনীতে ধর্মীয় ভন্ডামির মুখোশ খুলে দিচ্ছেন, সেখানেই, ‘দেবী’-তে নিজের হাতে শ্যামাসঙ্গীত লিখছেন সত্যজিৎ। আবার, ‘দেবী’ কিংবা ‘সদগতি’ ছবিতে যেখানে ধর্মের কুপ্রথা আর নিষ্ঠুরতা নিয়ে সরব সত্যজিৎ, সেখানেই জীবনের শেষ দিকে এসে ‘গণশত্রু’তে সত্যজিৎ বোঝাচ্ছেন, ধর্মব্যবসার সঙ্গে রাজনীতি জুড়ে গেলে সেটা কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সমাজের জন্য।
ধর্ম নিয়ে সত্যজিতের যা ভাবধারা, সেটা আজকের ভারতের রাজনীতিবিদ তথা ধর্মপ্রবক্তাদের হজম হবেনা। কিন্তু, ধর্ম নিয়ে বিভাজনের রাজনীতির মাঝে আজকের ভারতবর্ষে অবশ্যই প্রাসঙ্গিক সত্যজিতের এই ধর্মবোধ। সবশেষে এটাই বলার, সত্যজিৎ কোনোদিনই কিন্তু ধর্মকে আঘাত করতে চাননি, আঘাত করতে চেয়েছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই। নাহলে, কেউ কি নিজের জীবনের শেষ ছবি আগন্তুকে উৎপল দত্তের কন্ঠে নিজেই ‘হরিহরায় নমঃ’ গাইতে পারেন!
Discussion about this post