চৈত্র সংক্রান্তি মানেই গাজনের বাদ্যির আওয়াজ। আর সেই আওয়াজে বাঁকুড়াবাসী মেতে উঠবে না তাই আবার হয়? গাজনকে কেন্দ্র করে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, বড়জোড়ার অনেক নাম না জানা গ্রাম আনন্দে মেতে ওঠে। এই গাজন গুলির মধ্যে অন্যতম হল বাঁকুড়ার ষাড়েশ্বরের মন্দিরে গাজন। বিষ্ণুপুর থেকে কিছুটা দূরে দারকেশ্বর নদের তীরে ডিহর গ্রাম। এই ডিহর গ্রামেই আছে জোড়া মন্দির। এই জোড়ামন্দির ষাড়েশ্বর ও শৈলেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। মন্দির দুটিই ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি। মনে করা হয় বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজা পৃথ্বীমল্ল ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে এই জোড়া মন্দির তৈরি করেন। তবে ষাড়েশ্বর মন্দির আজও অসম্পূর্ণ। আজও কোনো চূড়া নেই এই মন্দিরের।
স্থানীয় মানুষ ছাড়াও ষাড়েশ্বর বাবার টানে যুগ যুগ ধরে বহু মানুষ এখানে ভিড় করে। বিশেষ করে এখানকার মন্দিরের গাজন উৎসব বেশি জনপ্রিয়। গাজন উপলক্ষে প্রায় ৫-৬ হাজার ভক্ত ও সন্ন্যাসী বিশেষ ব্রত পালন করে থাকেন। চারদিন ধরে এই গাজন উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনটিকে বলা হয় রাজভাটা বা রাজাভাটা। দ্বিতীয় দিন হয় দিন গাজন। তৃতীয় দিন রাত গাজন। চতুর্থ অর্থাৎ শেষদিনটি হল আঁশপান্না। যেহেতু মল্লরাজারা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই প্রথমদিন অর্থাৎ রাজাভাটার দিন ভক্তারা ষাড়েশ্বরের মূর্তি নিয়ে রাজপরিবারে যান।
দিনগাজনের দিন শালগাছের তৈরি পাটার ওপর কাঁটা রেখে তার ওপর কিছু ফলমূল রাখা হয়। এই পাটাটি মাথায় চাপিয়ে একধরনের নাচ করা হয়। এই শাল পাটাটিকে শিবের রুদ্রমূর্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়। রাত গাজনের দিন একধরনের লাঠি খেলা হয়। যারা ভক্তা হয় তাদের সবার কাছে থাকে লাঠি। সেই লাঠি নিয়ে তারা ঠোকাঠুকি করে। যাকে বলা হয় শিবের গর্জন। শেষদিন সমস্ত ভক্তারা মাছ খেয়ে তাদের ব্রত শেষ করে।
অন্যান্য জায়গার গাজনের মতো এখানেও ধুনো পোড়ানো, গড়ান দেওয়া এবং অন্যান্য শোভাযাত্রা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে হয়। হাজার হাজার মানুষ এবং সন্ন্যাসীর উপস্থিতিতেও “অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট” এই কথাটা খাটে না। নাগরদোলা, ঘুরন চরকি, মিষ্টির দোকান, চপ-মুড়ির দোকানে উপচে পড়ে ভিড়। চারিদিক বাহারি আলোয় ভরে ওঠে। ডিহর গ্রামের তরুণ সঙ্ঘের সদস্য এবং সিভিক ভলাণ্টিয়াররা সমস্ত ভিড় সামলায়। সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং স্থানীয় মানুষেরা বলে সারা বছরের ক্লান্তি, দুঃখ, মান-অভিমান সব ভুলে সকলে এক সাথে মহাদেবের পুজো দেন এবং আগামী বছর বাঁচার রসদ জোগাড় করেন এখান থেকেই।
চিত্র ঋণ – শুভদীপ সান্যাল
Discussion about this post