আর মোটে একটা দিন। বাংলা দিনপঞ্জিকায় তারপর নববর্ষের শঙ্খধ্বনি। বছরের শেষদিন এই চৈত্র সংক্রান্তি বাঙালিকে একরকম আবেগে আবিষ্ট করে। আর চৈত্র সংক্রান্তি মানেই বাংলার গ্রামে গ্রামে গাজন উৎসব। মস্ত লম্বা বাঁশের ডগায় পালক স্তরে স্তরে গেঁথে কাঁধে করে বয়ে বেড়ায় মন্দিরের সেবকরা। আর কানে ভেসে আসে একটা ছড়া “বাবা বুড়ো শিবের চরণের সেবা লাগে মহাদেব”। তবে এই উৎসবে আর একটি ঐতিহাসিক প্রথাও জুড়ে রয়েছে। আজ তা নিয়েই আলোচনার।
কথায় বলে ‘উচিৎ কথায় বন্ধু বেজার’। অর্থাৎ অপ্রিয় সত্য কেউ সহ্য করতে পারেনা সে আপনার যতই ঘনিষ্ট বন্ধু হোক না কেন। তাই সময়ে অসময়ে সেই সত্যকে বেমালুম হজম করে নিতে হয় সম্পর্কের খাতিরে। কিন্তু ওদের তো সেই সম্পর্কের দায় ছিল না। তাই অন্যায় দেখলেই তারা ছড়া কেটে ফেলত আর তাতে ওপরমহলের বাবুরা পড়তেন বিপাকে। তাই তাদের ছড়াগুলোকে ‘অশ্লীলতা’ বলেও ছাপ দিয়ে দিতেন শহরের উঁচু জাত। ভাবছেন তো কাদের এত বুকের পাটা যে কলকাতার সাহেবিয়ানা বাবুদের বিরুদ্ধে টিপ্পনী করে? তারা আর কেউ নয় তারা হল রাস্তার রঙচঙ মাখা সঙের দল। মাথায় ট্যাসওয়ালা টুপি, চাপকান, পেটি পরে যারা বেরিয়ে পড়ত চটুল গানের পসরা নিয়ে।
ঊনিশ শতকের কলকাতায় প্রায় সব উৎসবেই হানা দিত সঙেরা। তবে বিশেষ করে তাদের দেখা পাওয়া যেত চৈত্র সংক্রান্তির গাজন উৎসবে। পরে পরে এটা একপ্রকার যেন প্রথার আকার নেয়। গাজন এলেই সাধারণ মানুষের ভিড় জমত সঙেদের গান শুনতে। এরা মূলতঃ সমাজের কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টান্তগুলোকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা করে গান বাঁধত। কাজেই ওপরতলার বাবুরা বিশেষ খুশি হতেন না এদের আগমনে। কার সাথে ব্রিটিশদের আঁতাত, কে গোপনে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত, কার চরিত্রের দোষ রয়েছে এসবকেই বিষয়বস্তু করে রসিয়ে রগড় করাই ছিল সঙের গানের চরিত্র। এরা হল সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষ যেমন জেলে, কাঁসারি, মুচি। জেলেপাড়া আর কাঁসারিপাড়ার সঙগান তো সেসময় খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এদের মধ্যে জেলেপাড়ার সঙগান মূলত প্রতিবাদমূলক। সমাজের বিপক্ষে কিছু হলেই এদের চোখ তা এড়াতো না।
সঙ মিছিলের অভিনেতাদের গানের ভাষাও ছিল চটুল। একেবারে রোজকার মুখের ভাষাতেই গান বাঁধত তারা। অনেক জমিদার আবার ভাড়া করে আনতেন এদের যাতে অন্য জমিদারের ব্যঙ্গ গান শুনে মজা পান। স্বাধীনতা আন্দোলনেও কিন্তু এদের অবদান অস্বীকার করার নয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াকু গান লিখতেন বহু লেখক, ওরা তাতে সুর বসিয়ে গেয়ে বেড়াত বাড়ি বাড়ি। ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পালে তা হাওয়া তুলেছিল বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। আজকের দিনের সোশ্যাল মিডিয়ার ‘মিম’ এর সাথে এদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সঙরা যে সবসময় সঠিক বলত তা একেবারেই নয়। তবে তাদের ওই চটুলতাকে ভয় পেতেন শহুরে বাবুরা। তাই সামাজিক প্রেক্ষাপটে সঙ গানের গুরুত্ব অকল্পনীয়।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশরা আইনত নিষিদ্ধ করে এই সঙের গান। গাজনের দিনে সঙের গানের সেই মাদকতা হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। হারিয়ে যেতে থাকে সঙের দলগুলো। আজ শুধুই এক চিরাচরিত প্রথা হিসেবে কোথাও কোথাও বেঁচে রয়েছে এটি। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের দিন শিব দুর্গা সেজে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করাই এখন সঙের কাজ। হয়তো আর বেশিদিন নয় যখন সঙ শুধুই বাংলার এক ইতিহাস হয়েই পড়ে থাকবে হলদে বইয়ের পাতায়।
কভার চিত্র ঋণ – জিও বাংলা
Discussion about this post