দুর্গাপুজো মানেই থিমের ভিড়ের পাশাপাশি বনেদি বাড়ির পুজোর জাকজমক, আলোর রোশনাইতে সেজে ওঠা ঠাকুর দালান। আর সেই ঠাকুর দালানেই পরিবারের সকল সদস্যরা হইহই করে মেতে ওঠে পুজোর পাঁচটা দিন। উত্তর হাওড়ার এমনই একটি সাবেকি পুজো হল সালকিয়ার ঢ্যাং বাড়ির পুজো। প্রায় দেড়শো বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো। সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক নানান অজানা কাহিনী। চলুন আগে জেনে নিই ঢ্যাং পরিবারের বেশ কিছু অতীত ও ঐতিহ্যবাহী বিশেষত্ব।
বর্তমানে ঢ্যাং পরিবারের পুজো নামে পরিচিতি তৈরি হলেও এই বংশের মূল পদবী ছিল দে। তাদের ঢ্যাং উপাধি পাওয়ার কারণ অবশ্য আজও সবার কাছে অজানা। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ শ্রীরাম ঢ্যাং ১৮৭৩ সালে প্রথম দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন এই ঢ্যাং পরিবারে। তার পাঁচজন বংশধরেরা হলেন দেবেন্দ্রনাথ, মহাদেব, শিবচন্দ্র, রাখালচন্দ্র এবং তারকনাথ। পাঁচ পুত্রই যৌথভাবে ঢালাই কারখানা, তেলের ব্যবসা, তুলোর ব্যবসা এবং সুদূর সুইডেনে প্রস্তুত টেক্কামার্কা দেশলাইয়ের এজেন্সি নিয়েছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের যৌথ প্রচেষ্টাতে এবং ঈশ্বরের কৃপায় সালকিয়ার অন্যতম ধনী পরিবার হয়ে ওঠে এই ঢ্যাং পরিবার। সেই পরিবারের পুজো এখনও স্বমহিমায় ওই অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে আছে।
খিলান দেওয়া সাবেকি আদলের ঠাকুর দালান সেজে ওঠে পুজোর দিনগুলোতে। অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতোই এই বাড়িরও নিজস্ব কিছু রীতি আছে। যেমন, জন্মাষ্টমীর দিন থেকে শুরু করে কালীপুজা পর্যন্ত মাছ, মাংস ঢোকে না এই বাড়িতে। জন্মাষ্টমীর পর থেকে নতুন বাঁশ পুজো করে পরিবারের নিজস্ব প্রতিমা শিল্পী মূর্তি গড়ার কাজ শুরু করে দেন। টানা ১ মাস ৩০ দিন ধরে এই ঠাকুর দালানেই চলে মূর্তি গড়ার কাজ। পারিবারিক রীতি মেনে আজও ডাকের সাজে সেজে ওঠে প্রতিমা। পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী হুগলির রাজাহাটি থেকে পুরোহিত এবং ঢাকিরা চলে আসেন জন্মাষ্টমী তিথিতেই। তারা বংশানুক্রমে এখনও আসেন এই পুজোয়।
ষষ্ঠীর দিন মায়ের বোধন থেকে শুরু করে সপ্তমীতে গঙ্গায় নবপত্রিকা স্নান- সব কিছুতেই মিশে আছে এ বাড়ির পুরনো সংস্কৃতি। পরিবারের সদস্যরা অনেকেই কর্মসূত্রে থাকেন বিদেশে। কিন্তু দুর্গাপুজো মানেই বাঙালির ঘরে ফেরার টান। এখানেও তার অন্যথা হয় না। পরিবারিক মিলনে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে ঠাকুর দালান। সপ্তমীর বিকেলে রীতি মেনেই বারো ব্রাহ্মণকে লুচি, ফল, মিষ্টি ও দক্ষিণা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। অষ্টমীর দিন জনকোলাহলে মেতে ওঠে ঢ্যাং বাড়ির দুর্গাদালান। অষ্টমী পুজো ও সন্ধিপুজোতে ধুনো পোড়ার রীতি মানা হয়। অন্নভোগের বদলে সন্ধিপুজোতে একমণ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয় মাকে। পুজোর চারটে দিন হইহই করার পর আসে মায়ের বিদায় বেলা। বিষন্নতার সুর। তবে এভাবেই বছরের পর বছর ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হন ঢ্যাং পরিবারের বর্তমান প্রজন্মও।
Discussion about this post