“মাটি ছুঁয়ে থাকুক পায়ের ছাপ, পাতায় পাতায় থাকুক ভাতের ঘ্রাণ” – এই গানের আবহেই যেন আবার ফিরতে চাইছে শীতের পিকনিকের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য। প্লাস্টিক আর থার্মোকলের ভিড়ে ভুলে যাওয়া শালপাতার থালা-বাটি আজ নতুন করে পরিবেশবান্ধব ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠছে। প্রকৃতির কোলে বসে প্রকৃতিরই দেওয়া পাতায় খাবার খাওয়ার এই রীতি একসময় ছিল গ্রামবাংলা ও বনঘেরা এলাকার স্বাভাবিক সংস্কৃতি। আজ সেই সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতেই উদ্যোগী হয়েছেন উত্তরবঙ্গের বনসুরক্ষা কমিটি ও স্থানীয় মানুষজন।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলের সালুগারা রেঞ্জ এলাকায় বছরের পর বছর ধরে শালপাতার থালা, বাটি ও প্লেট তৈরির কাজ চলে আসছে। বনের পাশে থাকা গ্রামগুলির মহিলারাই এই কাজের মূল ভরসা। গাজোলডোবা, মান্তাদারি, আশিঘর নরেশ মোড়, রাসফাপরি – এই সব গ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে বিপুল পরিমাণ শালপাতা সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয় বন সুরক্ষা কমিটির হিসেব অনুযায়ী, একেকটি গ্রাম থেকে কুড়ি থেকে চল্লিশ হাজার পর্যন্ত শালপাতা সংগ্রহ হয়। থালা তৈরির জন্য যে শালপাতা সংগ্রহ করা হয় তা কেনা হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় প্রতি ১০০টি। আর প্লেট তৈরির জন্য সংগ্রহ করা শালপাতা গ্রাম থেকে কেনা হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় প্রতি ১০০টি।
আগে জঙ্গলে পড়ে থাকা শালপাতা সংগ্রহ করে গ্রামের মহিলারাই হাতে হাতে থালা বানাতেন। থালা তৈরি করতে লাগে প্রায় দশটি পাতা, প্লেটের জন্য লাগে ছ’টি পাতা। পাতাগুলো জোড়া লাগাতে ব্যবহার করা হত নারকেল, তাল বা সুপারি গাছের পাতার কাঠি কিংবা সরু ডাল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন মেশিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। সালুগারা রেঞ্জের অন্তর্গত শালপাতার কারখানায় বর্তমানে তিনটি মেশিনে প্রতিদিন দশ থেকে বারো হাজার থালা ও প্লেট তৈরি হয়। এই পরিবেশবান্ধব পণ্য শুধু দেশের বাজারেই নয়, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বাজারে শালপাতার থালার দাম প্রতি ১০০টি ৭০ টাকা এবং প্লেটের দাম ৬০ টাকা।
শীত এলেই পিকনিকের মরসুম শুরু হয়, আর তখনই বাড়ে প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব্যবহার। এই প্রবণতা রুখতেই সালুগারা রেঞ্জের বনকর্মী ও বন সুরক্ষা কমিটি কয়েক বছর ধরে পিকনিক দলগুলোর কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন – “থার্মোকল নয়, ব্যবহার করুন শালপাতার থালা-বাটি”। রেঞ্জার প্রদীপ করচৌধুরীর কথায়, পিকনিকের নামে প্লাস্টিক ব্যবহার বনের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই খোলাচাদফাপরি এলাকায় বনের মধ্যে গাছে গাছে লাগানো হয়েছে সচেতনতামূলক বার্তা – মদ্যপান নয়, ধূমপান নয়, প্লাস্টিক নয়। প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তাই শালপাতার থালায় ফিরে যাওয়া মানে শুধু ঐতিহ্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ বনকে বাঁচিয়ে রাখার এক সচেতন অঙ্গীকার।






































Discussion about this post