কোনও মৃত ব্যক্তি কিংবা তার পরিবারের জন্য শোকজ্ঞাপন আমরা সকলেই করে থাকি। কিন্তু এই শোক জ্ঞাপন করাকেই যারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারাই ‘রুদালি’। মৃত্যুর জন্য চোখের জল ঝরানো! রুদালি অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে মৃতের বাড়িতে গিয়ে কাঁদা। রাজস্থানে কালো পোশাক পরিহিত একদল নারীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তাদের প্রধান কাজই হল কেউ মারা গেলে তার উদ্দেশ্যে কাঁদা। বুক ফাটিয়ে, মাটি চাপড়ে হৃদয় বিদারক সুর করে কান্না-কাটি করাই তাঁদের প্রধান কাজ। কাঁদতে কাঁদতে দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা। তাদের কান্না দেখতে রীতিমতো মানুষের ঢল নামে ওই শোকের বাড়িতে। ভারতের এই পেশাদার সম্প্রদায় ‘রুদালি’ নামে পরিচিত। সাধারণের কাছে এটি একটি অদ্ভুত পেশা বলে মনে হলেও রাজস্থানে প্রায় কয়েকশো বছর ধরে টিকে রয়েছে এই ঐতিহ্য।
রুদালিদের পরনে থাকে কালো পোশাক। মৃত্যুর দূত যমের পছন্দের রং নাকি কালো। তাই মৃত্যুর দূতকে খুশি করতেই কালো রঙের পোশাক পরেন তাঁরা। রুদালিদের ব্যক্তিগত জীবনও অনেকটা তাঁদের পেশার মতোই। তথাকথিত নিচু বর্ণ থেকে উঠে আসা এই রুদালিদের সমাজে বিয়ে করার অনুমতি নেই! কারণ তাঁরা যদি নিজের পরিবারের মধ্যে সুখের ঠিকানা খুঁজে পায় তাহলে শেষকৃত্যে গিয়ে কাঁদবে কারা? কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে শোকের পরিবারে অন্য মানুষের কাঁদার কী প্রয়োজন ? আসলে সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের নারীদের অন্য সম্প্রদায়ের সামনে নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শনের অনুমতি নেই। তাঁরা বাড়ির আড়ালে থাকতেই অভ্যস্ত। আর তাঁদের জমানো দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটান এই রুদালিরাই।
রাজস্থানের ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের জীবন কাহিনী অবলম্বনে ১৯৯৩ সালে ভারতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ছবির চিত্রনাট্যে লিখেছিলেন গুলজার ও কল্পনা লাজমী। পরিচালনা করেন কল্পনা লাজমী। ছবিটির মূল বা নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন ডিম্পল কাপাডিয়া। এছাড়া ছবিটিতে অভিনয় করেন রাজ বাব্বর ও রাখী প্রমুখ, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ভুপেন হাজারিকা। ছবিটি ১৯৯৩ সালের ১৮ জুন মুক্তি পায়। ছবিটি ডিম্পল কাপাডিয়াকে যথেষ্ঠ খ্যাতি এনে দেয়। তিনি এ ছবির সাফল্যেই রূপালী পর্দায় তাঁর আসন পাকাপোক্ত করে নেন।
মাটিতে গড়াগড়ি, বুক চাপড়ে বা যত আবেগের সাথেই কান্নাকাটি রুদালিরা করুক না কেন, তাদের মজুরি মেলে নামমাত্র। সেই সাথে শত শত বছরের ঐতিহ্য হিসেবে রুদালিদের জন্য বরাদ্দ থাকে দুটি বাসি রুটি আর একটি কাঁচা পেঁয়াজ। তবে বর্তমানে কোনো কোনো পরিবার রুদালিদের এক বেলা ভাত খেতে দেয় এবং কালো রঙের পরনের একটি কাপড় দান করে। এক কথায় বলা যায় সমাজের উচ্চবর্ণ এবং নিচু বর্ণের যোজন যোজন ফারাক রাজস্থানী সমাজে ‘রুদালি’ নামের ওই সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে চলেছে। জমিদার শ্রেণি বা উচ্চ বর্ণের মানুষের কাছে ‘রুদালি’রা প্রায়শই শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীদের অনেকেই উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের অবৈধ সন্তানের জন্ম দেন। এ যেন রুদালিদের ললাটের লিখন। তবে রুদালি নারী যদি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তবে ওই সন্তানও ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়ে থাকে। কারণ ওই কন্যা সন্তান বড় হবার পর তাকেও রুদালি সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।
Discussion about this post