জনপ্রিয় ব্যান্ড নগর বাউল-এর কর্ণধার ও ভোকালিস্ট মাহফুজ আনাম জেমস। এই রকস্টার ভক্তদের কাছে গুরু নামে পরিচিত। যখনই স্টেজে উঠেন হাজার হাজার শ্রোতা গুরু গুরু বলে চিৎকার শুরু করেন। জেমস ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের নওগাঁয় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোজাম্মেল হক ছিলেন সরকারি চাকুরে।সেই সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে তাকে। জেমসের প্রথম স্কুল ছিল সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুল। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। নীলফামারী ও সিরাজগঞ্জের কলেজ জীবনে কেটেছে দারুণ কিছু সময়। বাবা মোজাম্মেল হক স্বপ্ন দেখতেন ছেলে বড় হয়ে সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে।
ছেলেবেলা থেকেই ছিলো জেমসের গানের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। গানের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ থাকায় তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। তার এই গান করা নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল তার বাবার। জেমস যখন কলেজে তখন মোজাম্মেল হক বুজলেন ছেলের আর পড়াশোনা সম্ভব নয়। পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলে জেমসের গায়ক-জীবন মেনে নিতে পারেনি বাবা মোজাম্মেল হক এবং মা জাহানারা খাতুন। আর তাই অভিমানী জেমসকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়। তাঁর গানের কথায়, ‘পথের বাপই বাপ রে মনা, পথের মা-ই মা…’। সেই পথ চলতে চলতে তাঁর ঠিকানা হয়ে যায় চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলি রোডে মতিয়ার পুলের সেই আজিজ বোর্ডিংয়ের ৩৬ নম্বর কক্ষটি। জেমস বলছিলেন, “আড্ডা আর গান যা-ই হোক না কেন সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনো ভুলব না।” এই কথাগুলোই জেমস বলেছেন ‘আজিজ বোর্ডিং’ গানটিতেও, “কত স্বপ্নের পায়রা ছুঁয়ে গেছে মন,/ শত স্মৃতির কিংখাবে,/ বন্দী সে দিন এখন।/ প্রিয় আজিজ বোর্ডিং, প্রিয় আজিজ বোর্ডিং।”
আজিজ বোর্ডিংয়ে গানের কথা আর সুরের নেশায় ঘুমহীন অনেক রাত কেটেছে জেমসের। সেখানে ছিল তাঁর ‘ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট একটি খাট/ ছোট্ট একটি টেবিল, একটি পানির জগ/ছিল একচিলতে আকাশ আমার / আর সেই প্রিয় গিটার।’ তারকা হয়ে ওঠার পর অবশ্য আর কখনোই সেখানে যাওয়া হয়নি তাঁর। তবে যে কক্ষে থাকতেন, সেখানে এখনকার বাসিন্দারা ‘গুরু’র জন্মদিনে কেক কাটে প্রতিবছর। পরিবার থেকেও নেই চট্টগ্রামের সেই ভবঘুরে জীবনে বন্ধুদের নিয়ে জেমস প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’। সেসময় সারাদিন গান তৈরিতে কেটে যেত তার। আর সন্ধ্যা গড়ালেই চলে যেতেন নগরীর নাইট ক্লাবে গান গাইতে। তারকা জেমসকে আজিজ বোর্ডিং কখনো পায়নি। পায়নি তাঁর মা-বাবাও। গানের জগতে জেমসের সাফল্যের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আগেই দু’জনই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। জেমস তাঁর ‘মা’ গানে বলেছেন, “সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখো, পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে”।
১৯৮৬ সালে ঢাকায় এসে প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করেন জেমস। ১৯৮৭ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে আসে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেন ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবাম। এই অ্যালবামের টাইটেল গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬), ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮), ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১), পালাবে কোথায় (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৭) এবং ‘কাল যমুনা’ (২০০৮) অ্যালবাম। ১৯৯৬ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ড থেকে নগর বাউল প্রকাশের পর থেকে ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘নগর বাউল’। ফিলিংস থেকে ‘নগর বাউল’ হয়ে নতুন যাত্রা শুরু হয়। এখনো পর্যন্ত ‘নগর বাউল’ নামেই গান পরিবেশন করছেন জেমস ও তার দলের সদস্যরা। অ্যালবাম প্রকাশের পাশাপাশি জেমস প্লেব্যাক করতে থাকেন। প্লেব্যাকেও তার গাওয়া গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে রয়েছে,’দশ মাস দশ দিন’, ‘আসবার কালে আসলাম একা’, ‘মীরাবাঈ’, ‘দেশা আসছে’, ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’, ‘পাগলা হাওয়ার তরে’, ‘এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন অন্তরে’ এবং’ বিধাতা’। প্লেব্যাকে তিনি দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শুধু দেশীয় প্লেব্যাকে নয়, বলিউডেও প্লেব্যাক করেছেন জেমস।
Discussion about this post