সদ্য পেরিয়েছে ভারতের প্রথম রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ১৬০তম জন্মদিন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রির এই অধ্যাপক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের ব্যবসায়িক প্রয়োগের জন্য ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’। এক সময় তাঁর জন্মদিন সাড়ম্বরে পালিত হত এই বেঙ্গল কেমিক্যালসেরই চার কারখানায়। কর্মীরা নিজ উদ্যোগেই আয়োজন করতেন বিভিন্ন সভা-সমিতির। কিন্তু সম্প্রতি যেন ভাঁটা পড়েছে সেই আনন্দে। কারণ দেশের গর্ব বেঙ্গল কেমিক্যালস যে আজ বন্ধের পথে! এ শুধু স্রষ্টার স্বপ্নভঙ্গ নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্নভঙ্গ এবং লজ্জাও বটে।
ইংরেজদের শাসনকালে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নেওয়া এই স্বদেশী উদ্যোগ ছিল বহুমুখী। দেশে এই প্রথম কোনো ফার্মা কোম্পানি গঠনের ফলে বেকার বাঙালি যুবকরা শুধুমাত্র চাকরির পিছনে না দৌড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যেও উৎসাহিত হয়। সত্তর-আশির দশকে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার কর্মী ছিলেন এই সংস্থায়। ছোট ল্যাবরেটরি হিসেবে পথচলা শুরু হলেও, এই কারখানার নাম অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এটিই দেশের প্রথম সংস্থা, যেখানে তৈরী হয় সাপের কামড়ের ওষুধ। অবশেষে ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক জাতীয়করণ হয় কোম্পানিটির। বিরাট কারখানা চত্বরে বর্তমানে উৎপন্ন হয় আধুনিক মেশিনসহ ওষুধ ও গৃহস্থালির সামগ্রী, তালিকায় রয়েছে স্যানিটাইজার এবং হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনও। কাঁকুড়গাছির কারখানায় কয়েক বছর আগে আমদানি হয়েছে অত্যাধুনিক মেশিন। বিগত কিছু বছরে সংস্থাটি লাভ করেছে ৪০০ কোটি টাকা, এর মধ্যে ২০২০ অর্থবর্ষেই লাভের পরিমাণ ১৩০ কোটি। কিন্তু এত কিছুর পরেও বর্তমানে কেন্দ্রের বেসরকারিকরণ নীতির কোপে পড়ে ধূলিসাৎ হওয়ার পথে এই বেঙ্গল কেমিক্যালস। ২০১৬ সাল থেকেই পানিহাটিতে সংস্থার ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে কেন্দ্র, বর্তমানে যার মূল্য প্রায় ১০০০ কোটি টাকা।
যে ঐতিহাসিক সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালির আবেগ-সম্মান-ঐতিহ্য, সেই প্রতিষ্ঠানকে আর পাঁচটা কোম্পানির মতো বিকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে কর্মীরা। রাজ্যে ক্রমাগত বেড়ে চলা বেকারত্বের যুগে এই কারখানায় যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে নতুন নিয়োগেরও। সিটু ইউনিয়নের উদ্যোগে কারখানা চালু রাখার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন গড়িয়েছে হাইকোর্ট অবধি, যদিও এখনও হয়নি নিষ্পত্তি। কোম্পানি বিক্রির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে আরও কার্যকরভাবে কোম্পানিকে চালানোর আবেদন জানিয়ে কর্মীদের তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকেও। এই পরিস্থিতিতে কিছুদিন আগে আচার্যের জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করেই কলকাতার বুকে এক অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে একটি সংস্থা। যার নাম ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল সুহৃদ সমাজ’।
“জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানাকে ওষুধ উৎপাদনে সচল রাখতে হবে” – এই দাবি নিয়ে ১ আগস্ট আয়োজিত হয় একটি সাইকেল র্যালি। এতে যোগ দিয়েছিলেন কারখানার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, ছাঁটাই শ্রমিক ও স্থানীয় মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন। কাঁকুড়গাছিতে বেঙ্গল কেমিক্যালসের গেট থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকা ও বাজার জুড়ে চলে পরিক্রমা, বিলি হয় লিফলেট। বাজার করতে এসে সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান গেয়ে সকলকে উদ্বুদ্ধ করে যান। সংস্থার তরফে রঘু জানা ‘ডেইলি নিউজ রিল’কে জানিয়েছেন, “কারখানাটা যে চলছে, এটাই এখনও অনেক মানুষ জানেন না। তাই সাধারণ মানুষের মনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।” পরবর্তীকালে আরও এই ধরণের ব্যতিক্রমী কর্মসূচী গ্রহণ করে এই লড়াই চালিয়ে যেতে চান তাঁরা। তবে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয় কিছুই। তাই তাঁদের অনুরোধ, আপনিও আপনার ভাবনা-চিন্তা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসুন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আবেদনে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে, এই আশা রাখি আমরাও!
Discussion about this post