খবরের কাগজের পাতা খুললে এক ধরণের খবর প্রায়শই চোখে পড়েই, তা হল ‘ধর্ষণ’। দূরদর্শন, রেডিও চ্যানেল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও অতি আলোচিত একটি বিষয় এটি। ধর্ষণের ‘দোষ’ হিসেবে ধর্ষক নয় বরং ধর্ষিতার চরিত্র নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসে যান মানুষজন। ধর্ষিতা মেয়েটি কত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকে এবং তার পুরুষ বন্ধুর সংখ্যাই বা কত, এসব বিচার করেই তার চরিত্র মাপা হতে থাকে। অন্যদিকে ধর্ষকদের মানসিকতা বা মেয়েদের ‘মাল’ হিসেবে দেখার চোখ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয় খুব কমই। সমাজে ভদ্রভাবে থাকার দায় একমাত্র নারীদেরই। তাই বেশি রাতে বাড়ি ফিরলে তার দায় নিজেকেই নিতে হবে। ধর্ষণ থেকে বাঁচার সবথেকে সহজ উপায় বরং বাড়ি থেকেই না বেরোনো। এই সমাজে সুরক্ষিত থাকতে গেলে এভাবেই নিজেকে ‘রক্ষা’ করতে হবে।
ধর্ষণের কারণ হিসেবে আরেকটি জিনিসও প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। তা হল নারীর পোশাক। যত খোলামেলা পোশাক পরা হবে, ধর্ষণের সুযোগও তত বেশি দেবে কেউ। ‘উত্তেজিত’ ও ‘অশ্লীল’ পোশাক পরে নারীরা নাকি ধর্ষকদের উত্তেজিত করে তোলে। ঠিক এই কারণের জন্যই তারা ধর্ষণের স্বীকার হন। অথচ নির্ভয়া থেকে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি তাদের সবার পোশাক যথেষ্টই ভদ্র ছিল। তারপরেও তারা ধর্ষিত হন। ধর্ষণের শিকার হন আট মাসের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধাও। তাই ধর্ষণের ক্ষেত্রে পোশাক যে দায়ী একথা ভুল প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। আসলে আমাদের সমাজের রন্ধে রন্ধ্রে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে। এই সমাজ ‘লোলুপ’ পুরুষের নজরই নারীকে চিনতে সেখায়, তাদের ‘মাল’ বলে ভাবতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে আরও একটি কথা ভীষণ ভাবেই প্রযোজ্য। পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা কিন্তু কোনও ‘বায়োলজিক্যাল টার্ম’ নয়। সমাজে শুধু পুরুষরাই পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে বেঁচে আছে এটি একেবারেই ভুল কথা। বরং একটি মেয়েও সমানভাবেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকে লালন করতে পারে।
ছোটবেলা থেকেই বাড়ির মা-ঠাকুমারা আমাদের মনে একটা কথা ঢুকিয়ে দেয়। বড় হলে মন দিয়ে সংসার করতে হবে। একজন মেয়ে যদি চাকুরীজীবীও হয় তবুও সংসার সাজানোর দায় একমাত্র তারই। একথা বাচ্চা বয়স থেকেই আমাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। নারীরা আজ সেনাবাহিনী থেকে মহাকাশ সর্বত্রই বিচরণ করছেন। কিন্তু সমাজের মানসিকতা আজও একফোঁটা বদলায়নি। নির্ভয়া-কান্ডের আসামীদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে অনেকদিন। এরপর বারবার ফাঁসির দিন বদল হয়েই চলেছে। কিন্তু ফাঁসিটা হয়ে উঠতে পারেনি এখনও। কবে হবে তারও কোনো সদুত্তর নেই। তবে ফাঁসি হলেও মানসিকতার বদল না এলে এই সমাজে কিছুর পরিবর্তনই আসলে হয়ে উঠবে না। সবার আগে বদল চাই আমি পুরুষ, তুমি নারী এই বিভাজনের। নারীকে শুধু একতাল মাংস বা শরীর হিসেবে না দেখে, একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নকে সফল করবে আগামী প্রজন্ম, এই আশা রাখার চেষ্টা করতে পারি আমরা। এভাবেই হয়ত একদিন নির্ভয়া, অপরাজিতা, প্রিয়াঙ্কারা রাত দিনের ফারাক না করে ঘরেই বাইরে নিরাপদ থাকবে।
Discussion about this post