মেটিয়াবুরুজ গার্ডেনরিচ আর খিদিরপুর ডক। এই অঞ্চলগুলোর নাম শুনলেই কি আপনার মনে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে? তা অবশ্য হওয়ারই কথা। হাজার হোক এটিই যে ভারতের ‘মিনি পাকিস্তান’ নামে অভিহিত। আর পাকিস্তান মানেই চট করে আমাদের মাথায় খেলে শত্রুপক্ষ কিংবা এক সন্ত্রাসবাদের আখড়া। আর সেই পাকিস্তানকে ভারতে খুঁজে পাওয়া গেলে মানুষের চোখ তো বাঁকবেই, তাই না? কিন্তু এই যে এত বিদ্রুপ বা ধিক্কার চলে এই অঞ্চল ঘিরে সেটা কি সত্যিই গ্রহণযোগ্য? সত্যিই কি দেশ তথা রাজ্যের অন্ধকারময় এক ভয়ঙ্কর জায়গা এই মেটিয়াবুরুজ? প্রচলিত অপবাদের আড়ালে আসল সত্যিটা কী?
হুগলী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এই মেটিয়াবুরুজ। নবাবী আমলের মাটির বড় কেল্লাগুলোকে ব্রিটিশরা একসময় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পড়ে থাকা মাটির ঢিবি বা বুরুজ থেকেই এই অঞ্চলটি হয়ে ওঠে মেটিয়াবুরুজ। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এই গার্ডেনরিচ ও মেটিয়াবুরুজের সম্পূর্ণ অঞ্চলকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে একটি সাক্ষাৎকার দেন । আর তারপর থেকেই রণদামামা বেজে গেল চারিদিকে। এই অঞ্চলটি সবার কাছেই হয়ে উঠল চোখের বিষ। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো! আমেদাবাদ যদি ‘ভারতের ম্যানচেস্টার’ হতে পারে, হিমাচল প্রদেশ যদি ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ তকমা পায়, শিলং যদি পূর্বভারতের স্কটল্যান্ড হয়, তবে মেটিয়াবুরুজের ‘মিনি পাকিস্তান’ হওয়াতে সমস্যা কোথায়? মেটিয়াবুরুজের ৮৫% মানুষই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যার কিছু সেই নবাবী আমল থেকে রয়েছেন, আবার অনেকে বাংলাদেশ থেকেও এসেছেন। এদের রীতিরিওয়াজ, খাদ্যাভাস, অনুষ্ঠানিক সমাবেশ, রোজকার জীবনশৈলীর সঙ্গে বেশ খানিকটা মিল রয়েছে পাকিস্তানী ধাঁচের। তাই পাকিস্তানের ছোট সংস্করণ বলতে আপত্তি হওয়ার নয়। এরপরও কি আপনাদের কিছুটা সন্দেহ থেকেই গেল? তবে চলুন কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়াই শুনে নেওয়া যাক, যাঁরা প্রতিনিয়ত খুব কাছ থেকে এই অঞ্চলকে দেখে আসছেন।
বিগত দু’বছর ধরে মেটিয়াবুরুজ ও গার্ডেনরিচে কর্মরত দমকল কর্মী রবেন্দু ভট্টাচার্য্য জানান, এই অঞ্চল সম্পর্কে যেটুকু শোনা যায় বেশিরভাগটাই অপপ্রচার। কাজের ক্ষেত্রে ওখানের মানুষের চূড়ান্ত সহযোগিতা পেয়েছেন বলেও স্বীকার করেন। হিন্দুর প্রতি মুসলিমদের বিদ্বেষ কোনদিন দেখেন নি তিনি। মেটিয়াবুরুজের অলিগলিতে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা ইমাম আলী মোল্লার মতে এখানে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ একদমই নেই। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিময় সহাবস্থানই লক্ষ্য করা যায়। মেটিয়াবুরুজের বদরতলা এবং কাশ্যপ পাড়ায় হিন্দুদের দুর্গাপূজাও হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। আর সেখানে আর্থিক থেকে কায়িক সাহায্য করে থাকেন বহু মুসলিম।
২০ বছর ধরে মেটিয়াবুরুজের সাথে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যুক্ত থাকা সুকুমার দাস জোর দিয়ে বলেন অসহায়ের পাশে সবসময় দাঁড়ায় এই মেটিয়াবুরুজ। ধর্মে হিন্দু বলে কখনও খারাপ ব্যবহার পাননি তিনি, বরং অসুবিধায় পড়লে বহুবার সাহায্য পেয়েছেন ওদের থেকে। প্রয়োজনে ৩-৪ দিন থেকেও যান এদের বাড়িতে তবু ধর্ম নিয়ে সমস্যা হয়নি কোনোদিন। স্থানীয় ব্যবসায়ী অনিসুর মোল্লার মুখ থেকেও শোনা যায় সেই সম্প্রীতির গল্প। এক সাথে বসে খাবারও খান দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ। ক্রেতা থেকে কাঁচামাল লেনদেনকারী বহু হিন্দু ও মুসলিম মানুষ এখানের বস্ত্রশিল্পের সাথে জড়িত। কিন্তু ধর্মের খাতিরে মনোমালিন্যের লেশমাত্র নেই। তবে ৮০-৯০ দশকে বেশ কিছু ক্রিমিনালদের উৎপাত ছিল এই অঞ্চলে। ঘটেছে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও। কিন্তু আজ তারাও রুজি রোজগারের তাগিদে মিশেছে স্বাভাবিক জনজীবনে। দু-একটা ঘটনা বাদ দিলে অপরাধ থেকে বর্তমানে শত হাত দূরে মেটিয়াবুরুজ এটুকু আশ্বস্ত করেন তিনি। বহু ব্যবসায়ীর আনাগোনা থাকা সত্ত্বেও কোনোদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনার সাক্ষী হতে হয়নি কাউকেই।
কাজেই মেটিয়াবুরুজ বাংলার আর পাঁচটা জায়গার মতোই এক সাধারণ জায়গা। শত শত মানুষের দেদার কাপড়ের ব্যবসা চলে এই অঞ্চল জুড়ে। কাজের ক্ষেত্রে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সংযুক্তি। আবার ধর্মপালনেও নেই কোনো জোরাজুরি। দূর থেকে দেখে মেটিয়াবুরুজকে এক বিভীষিকা মনে হলেও কাছে এসে দেখুন সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনের গন্ধটা ঠিক পাবেন।
কভার চিত্র ঋণ – whatsuplife, তথ্য ঋণ – ইমাম আলি মোল্লার গবেষণা লব্ধ ফেসবুক পোস্ট
Discussion about this post