হাতে আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার অপেক্ষা। তারপরেই বাংলা নতুন বছরের ভোর। পয়লা বৈশাখে নতুন জামা কাপড়, মিষ্টির বাক্সের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে আরেক রীতি ‘হালখাতা’। সময়ের সঙ্গে অন্যান্য অনেক কিছুর মতো হালখাতারও আকার ও আকৃতির বিবর্তন ঘটেছে। অনেক বছর আগে হালখাতা হিসাবে যে ‘খেরোর খাতা’ ব্যবহার করা হত, তা ছিল লম্বাটে ধরণের। তবে হাল আমলের যন্ত্র নির্ভরতা হালখাতার ব্যবহারিক গুরুত্ব সারা বছরে অনেকটা কমালেও পয়লা বৈশাখে এর তাৎপর্য আজও একইরকম।
কলকাতায় শিয়ালদার বৈঠকখানা রোডে রয়েছে পরপর হালখাতা তৈরির দোকান এবং কারখানা। বেশ কিছু বছর আগেও এখানে পয়লা বৈশাখের আগে ভিড় থিকথিক করত। এই অঞ্চলে মতিয়ার রহমানের কারখানা চল্লিশ বছরের বেশি পুরনো। তাঁর কথায়, নববর্ষের দেড় মাস আগে থেকে খাতা তৈরির কাজ শুরু হয় এখন। তবে আগে চাপ বেশি থাকায় কালী পুজোর পর থেকেই কাজ শুরু করতে হত। এছাড়াও আছে নূর আলম খানের কারখানা। নূর আলম তাঁর চার ছেলেকে চারটি কারখানা বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হালখাতার চাহিদা খুব কমে যাওয়ায় তিনটি কারখানা বর্তমানে বন্ধ। বৈঠকখানা রোডের পাশের মাছপট্টিতে বেশ কয়েক বছর আগেও বড় করে হালখাতার পুজো হত। তবে সেসব এখন অতীত।
মহাত্মা গান্ধী রোডের পাশে সোনাপট্টিতেও রয়েছে পরপর দোকান। সেখানে গোবিন্দ সাহাদের এই ব্যবসা প্রায় নব্বই বছরের পুরনো। তাঁর কথায়, আগে পয়লা বৈশাখের ৮-১০ দিন আগে থেকে কাজের চাপে তিনি মাথা তুলতে পারতেন না। কোভিড কালে মন্দা দেখা গেলেও পরিস্থিতি আগের থেকে একটু ভালো। তবে তাঁর বক্তব্যও একই। কম্পিউটারে হিসাব রাখা অনেক বেশি সুবিধাজনক হওয়ায় হালখাতার ব্যবহার অনেকটা কমে গেছে। তাছাড়া, কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও বেড়েছে, বেড়েছে মজুরিও। সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাতার দামও। সবকিছু মিলিয়ে এখন হালখাতার সত্যিই বেহাল দশা।
তবে হালখাতার ব্যবহার কমে যাওয়া নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে নারাজ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তার মতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাতেই তিনি আগ্রহী বেশি। নববর্ষের হালখাতার দিন বইপাড়ায় লেখক ও প্রকাশকের বার্ষিক মিলনোৎসবেরও দিন। দু’জন লেখকের মুখ দেখাদেখির দরজা সারা বছর বন্ধ থাকলেও এইদিন নতুন খাতা খোলার মতো করেই খুলে যেত সেই বন্ধ দরজাও। প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং প্রবোধ কুমার সান্যালের বন্ধ হওয়া কথা শুরু হয়েছিল এমনই এক অনুষ্ঠানে প্রমথনাথ বিশী’র কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে, “আসিবে লেখক / কেহ বা একক/কেহ বা সদলবলে, পাড়ার লোকেরা/ হবে দিশেহারা/ দারুণ সে কোলাহলে। প্রবোধ প্রেমেন/দোহে আসিবেন/ বসিবেন পাশাপাশি / ভুলিয়া বড়াই/ কাগুজে লড়াই/ আহা কী মধুর হাসি।” এও নববর্ষের হালখাতায় এক প্রাপ্তিই বটে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – Rostrum
Discussion about this post