গঙ্গারে লইয়া জান আনন্দিত হইয়া আসিয়া মিলিল গঙ্গা, তীর্থ যে নদীয়া। সপ্তদ্বীপ মধ্যে সার নবদ্বীপ গ্রাম একঅরাত্রি গঙ্গা তথা করিল বিশ্রাম।”
গঙ্গারে লইয়া জান আনন্দিত হইয়া আসিয়া মিলিল গঙ্গা, তীর্থ যে নদীয়া। সপ্তদ্বীপ মধ্যে সার নবদ্বীপ গ্রাম একঅরাত্রি গঙ্গা তথা করিল বিশ্রাম।” কৃত্তিবাসীয় রামায়ণে এভাবেই, পশ্চিমবঙ্গের ছোট্ট জেলা নদীয়ার বর্ণনা ফুটে উঠেছে। এমনকি ভিন্ন নামে ভিন্ন পুরাণ ইতিহাসে অস্তিত্ব মেলে এই অঞ্চলের। আর নদীয়ার নবদ্বীপ হল বাঙালির চিরকালের আবেগের স্থান। আর চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর এক পুণ্যতীর্থে পরিণত। শ্রী কৃষ্ণের চারণভূমি নবদ্বীপ। ভগবান কৃষ্ণ আর ভক্তের সেই মিলন উৎসবই হল ‘রাস উৎসব’। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা গিরীশচন্দ্র প্রচলন করেন রাসের। শুরুতে পটপূজা হলেও, পরে মূর্তির চল আসে। আরও পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তা ‘শাক্তরসে’ পরিণত করেন। কৃষ্ণ ও কালীর একসাথে পুজো হয় এই কার্তিকী পূর্ণিমায়। শোনা যায় ‘শাক্তরাস’ উৎসবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বারোয়ারি পুজোয় ১টাকা করে দান করতেন। এখানের রাসে ভিন্ন শক্তির দেবীর আরাধনা হয়। তাদের মধ্যে কিছু বিশেষ পুজোর কথা আমরা তুলে ধরলাম।
বড় শ্যামা মাতা – ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ২৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বড়শ্যামা মাতা নবদ্বীপের তেঘরী পাড়াতে রাস পূর্ণিমাতে পূজিত হন। এই পূজার প্রতিষ্ঠা করেন তন্ত্রসাধক ভৃগুরাম। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভৃগুরামকে তেঘরী মৌজায় ১২০০ বিঘা ভিটা জমি ও ১০০০ বিঘা মাঠের জমি দান করেছিলেন। ভৃগুরামের তিন পুত্র গদাধর, কৃষ্ণরাম রামগোপাল। এই বংশের লোক ছাড়া বাইরের কোন পুরোহিত দিয়ে পুজো করার নিয়ম নেই। বড় শ্যামা মাতার সারা বছর ঘটে পুজো হয়, শুধুমাত্র রাস পূর্ণিমাতেই মূর্তি গড়ে পুজো হয়। বড়শ্যামা মাতার পুজোয় জনসাধারণের থেকে কোনো চাঁদা নেওয়া হয় না। ‘দি ট্রাস্টিস অব বড়শ্যামা মাতা’র তহবিল থেকেই আয়োজন হয় পুজোর।
বামাকালী মাতা – নবদ্বীপ রামসীতা পাড়ায় বামাকালী মাতা পূজিতা হন। সাবেকি পুজো, অসাধারণ সুসজ্জিতা মায়ের মূর্তি। এখানে মায়ের বাম পা শিবের বুকের ওপর থাকে তাই বামাকালি বলা হয়। কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশের সৃষ্ট দক্ষিণা কালীমূর্তিতে কালীর ডান পা শিব বক্ষে থাকে, বামাকালী কিন্তু বিপরীত! গৃহস্থের ঘরে এই পূজার নিয়ম নেই। মা তন্ত্র মতে পূজিতা হন।
শবশিবা মাতা – শবশিবা কিন্তু এক বিচিত্র তান্ত্রিক মূর্তি, লোকমতে নিচে জড়বত্ শিব তার ওপর মহাকালের সঙ্গে বিপরীত রতিক্রিয়ায় মগ্ন কালী। কালিকাপুরাণ মতে প্রেতবত্ শিবের সাথে দেবীর সঙ্গম মূর্তি। ব্যাদরাপাড়া ছাড়াও নবদ্বীপের আরও দুই শবশিবা পূজিতা হন একটি ভুতেশ্বরী নাম এবং অন্যটি আমপুলিয়া পাড়ায়। তবে শিতিকন্ঠ বাচস্পতির আমপুলিয়া পাড়ার কালী শ্যাম বর্ণা নন, গাঢ় নীল রূপেই তিনি পূজিতা। তবে এতোগুলির মধ্যে ব্যাদরা পাড়ারটিই সবচেয়ে প্রাচীন – পুজো শুরু হয়েছিল প্রায় কয়েকশো বছর আগে।
রণকালী – মায়ের ডান পা এগিয়ে, তন্ত্রমতে পূজিতা। রাধাবাজারের রণকালি মাতা মালো সম্প্রদায়ের সুপ্রাচীন পুজো।
ভদ্রকালী মাতা – রামচন্দ্র পাতালপুরী থেকে দুর্গা মা’কে নিয়ে এসে আশ্বিন মাসে মায়ের পূজা দেন একে অকালবোধন বলা হয়। ভদ্রাকালী মাতা সেই অকালবোধনের আগের রূপ। হনুমান, রাম, লক্ষ্মণ মা’কে নিয়ে আসছেন। দু’টি ভদ্রাকালী মাতার পুজো হয় নবদ্বীপে।
গৌরাঙ্গিনী মাতা – যোগনাথ তলার গৌরাঙ্গিনী মাতা নবদ্বীপের ঐতিহ্য। পূজার পরের দিন ১০৮ জন বেয়ারার কাঁধে প্রতিমার শোভাযাত্রা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মা দুর্গা অসুর বিজয়ের পরের রূপ এই মূর্তি। কমিটির সময়কাল অনুযায়ী ১৯০ বছরের প্রাচীন পুজো এটি। ১৮৬০-৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত প্রবল বন্যা বা ভূমিকম্পে পুরাণগঞ্জ ধ্বংস হয়েছিল। রেকর্ড থেকে জানা গিয়েছে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রবল বন্যা হয়েছিল। এখানে, সম্ভবত এই বন্যাতেই পুরাণগঞ্জ গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখানকার অধিবাসীরা বর্তমান শ্ৰীবাস অঙ্গন পাড়ায় উঠে আসেন। পুরাণগঞ্জের বিন্ধ্যবাসিনী শ্ৰীবাস অঙ্গন পাড়ায় পূজিতা হতে থাকেন। কয়েক বছরের মধ্যে গোষ্ঠীকেন্দিলে এটি ভাগ হয়ে যায়। একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে খড়ের গোলার বিন্ধ্যবাসিনী আর অন্যটি গৌরাঙ্গিনী নামে প্রতিষ্ঠিত হয় যোগনাথতলায়। রাজপুরোহিত অসীমকুমার ভট্টাচার্য নথিপত্র ঘেঁটে জানালেন যে, গোলকী নাথ ন্যায়রত্ন এই দেবীর ধ্যান রচনা করেছিলেন।
কৃষ্ণকালী – নবদ্বীপের ফাঁসিতলার কৃষ্ণকালী পুজো শুরু হয় ১৯১৫ সালে। নবদ্বীপ রাস উত্সবের অনেক বৈচিত্রময় মূর্তির মধ্যে এটি অন্যতম। কৃষ্ণকালী আসলে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের এক অপূর্ব মিলন দেখা যায়।.. জনশ্রুতি আছে, এই পুজোর বিধান বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল।
এ্যালানে কালী – শক্তি উপাসক ভৃগুরাম নবদ্বীপে ভাগীরথীর তীরে আসেন। পঞ্চমুন্ডির আসনে এই শক্তির পুজো করেন। নাম ছিল এ্যালেন কালী। পন্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ এই কালীর পুজোর প্রচলন করেন।
মহিষাসুরমর্দিনী – নবদ্বীপ রাসে মহিষাসুরমর্দিনী মাতার পুজোই বেশি হয়ে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পূজার মধ্যে আসে নন্দী পাড়া, ছোট বাজার, ও পোড়ামাতলার মহিষাসুরমর্দিনী পুজোর নাম। পোড়ামাতলার মহিষাসুরমর্দিনী এক মাত্র পুজো যেখানে মায়ের ৩ দিন ধরে পূজা পর্ব উদযাপিত হয়।
রাসের নবমী উৎসবে, পুজো সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে যায়। প্রায় ৫০০ শোভাযাত্রার শোভা চারপাশে। বাজনার সুর। নবদ্বীপের চারিদিক জুড়ে তখন এক আলাদাই পরিবেশ। কিন্তু সময় তো একটু করে এগিয়ে চলে। এভাবে একদিন সময় আসে নিরঞ্জনের। বিসর্জনের মন খারাপ তখন গোটা নবদ্বীপ জুড়ে। ফের শুরু হয় নবদ্বীপবাসীর, এক বছরের অপেক্ষা পর্ব।
তথ্য ঋণ – সপ্তক দাস, নবদ্বীপ রয়েল সোসাইটি
Discussion about this post