বাংলাদেশের সাথে কবিগুরুর এক আত্মিক যোগাযোগ ছিলো বরাবরই। শিলাইদহের পদ্মায় ভেসে কাটিয়েছেন অনেকটা সময়, লিখেছেন বহু কবিতা-উপন্যাস। তেমনই শাহজাদপুর ছেড়ে আসতে তার মন ভেঙেছে। অনেকেরই অজানা রবি ঠাকুরের সাথে বাংলাদেশের আরেক সম্পর্ক তার সহধর্মিনীর পিত্রালয়। খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহিতে আজও রয়েছে বিশ্ব কবির শ্বশুরালয়। দক্ষিণডিহি গ্রামের ঠিক মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য সেই দোতলা ভবন। সেখানে এখনো আছে বিশ্বকবির আবক্ষ ভাস্কর্য, কবিপত্নীর আবক্ষ ভাষ্কর্য। এছাড়া রয়েছে সবুজ-শ্যামল ঘন বাগান, পান-বরজ ও নার্সারি।
ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণ ডিহির সম্পর্ক বরাবরের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবীর জন্মস্থানও এই দক্ষিণডিহি গ্রাম। কবির কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীও এই গ্রামেরই মেয়ে। যৌবনে কবি কয়েকবার তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামা বাড়িতে এসেছিলেন। তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও এই দক্ষিণডিহিরই মেয়ে। ১৮৮২ সালে পুজার ছুটির সময় ঠাকুরবাড়ির মেজো বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হয়ে বাস্তুভিটে দেখবার অজুহাতে যশোরের নরেন্দ্রপুর যান। উদ্দেশ্য কাছাকাছি পীরালী পরিবারের মধ্য হতে কূলবধু বাছাই। তার সঙ্গে কাদম্বরী দেবী, বালিকা ইন্দ্রানি, সুরেন্দ্র নাথ ও রবীন্দ্রনাথও আসেন পুরনো ভিটে দেখতে। তখন তারা ফুলতলা গ্রামের বেনীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিনীকে তারা দেখেন। ২২ বছর বয়সে কবির বিবাহ হয় দক্ষিণডিহির বেনীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিনী ওরফে মৃণালিনী দেবীর সাথে। তার ভালো নাম ভবতারিণী, বিয়ের পর ঠাকুর পরিবার তার নাম রাখেন মৃণালিনী দেবী।
জোড়াসাঁকোর জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণী দেবী। রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী তার খোঁজ দিয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী শ্বশুর মশাইকে বিস্তারিত জানালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যথারীতি কুল-গোত্র ইত্যাদি দেখে বিয়ে ঠিক করেন। ২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ রবিবার ইংরেজি ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। তবে বাঙালির সমাজে তার এই বিবাহ নিয়েও কম চর্চা হয়নি। এই দিন ঠাকুরবাড়িতে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের বড় বোন সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় শিলাইদহে মারা যান। কলকাতা শহরের রাজপুত্তুরের জন্য এঁদো গ্রামের অল্প শিক্ষিতা এই মেয়ে? নিয়ম অনুযায়ী পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য পাত্রীর পিত্রালয়ে যায়। তবে এই বিয়েতে পাত্রীকে পাত্রের বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রীপক্ষ সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন। তাদের ভাড়াবাড়ি এবং যাতায়াতের সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার ক্যাশ বইতে সে হিসেব রয়েছে। নতুন জামাইয়ের আপ্যায়ন না হবার গুঞ্জন ওঠে। তবে সমস্ত অনুষ্ঠান জোড়াসাঁকোতে হলে আপ্যায়নের সুযোগ না পাওয়ারই কথা।
কবিগুরুর বিয়ে নিয়ে মতামত একরকম তার বৌঠানদের মাধ্যমেই দিয়েছিলেন। তবে বিয়ের পর তার আর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়নি। এমনকি মৃণালিনী দেবীও তারপর সেখানে আর একবারই গিয়েছিলেন। এখন যে বাড়িটি ফুলতলাতে আছে তা তাদের বিয়ের পর বানানো। সুতরাং কবিপত্নীরও ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি নেই সেখানে। প্রথমে সংস্কারের অভাবে নষ্ট গেছে বাড়ির অনেক স্মৃতিচিহ্ন। এই দ্বিতল ভবনের উপর একটি চিলে কোঠা রয়েছে। মূলভবনের নীচতলায় ৪টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২টি কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ দিকে একটি বারান্দা আছে। ভবনের স্থাপত্য ও গঠন কাঠামোতে বৃটিশ যুগের স্থাপত্যরীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই ভবন নির্মিত হয়েছিল। ২৫শে বৈশাখ ও ২২শে শ্রাবণে এখানে নানা আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তী ও কবিপ্রয়াণ দিবস পালন করা হয়। গ্রামীণ নিবিড় পরিবেশে এই বাড়ি যে কারো মন ভুলিয়ে দিতে বাধ্য।
Discussion about this post