উনিশ শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি সময়। সমাজ-সংস্কারক ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ও প্রথম মেয়ে ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির ছাদেই রবীন্দ্রনাথ আসতেন মাঘোৎসবের প্রস্তুতি হিসেবে উৎসাহী নারী-পুরুষদের গান শেখাতে। আর বেহালা হাতে নিয়ে বসতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে এটি স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রায় পরিবারের যোগাযোগ বহুদিনের। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের তাতা চরিত্রের নাম অনুসারে সুকুমার রায়ের ডাকনামও ঠিক হয়।
সেই সূত্রে ছোট থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয়। কবি সুকুমারকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের নিয়মিত দেখাও হত। সুকুমার লন্ডনে গিয়েছিলেন মুদ্রণ শিল্পে সর্বোচ্চ পড়াশোনা করতে। তখন রবীন্দ্রনাথও লন্ডনে। সুকুমার রায় সেখানে ‘The spirit of Rabindranath Tagore’ নামে একটি প্রবন্ধ পড়েন। এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে বিদেশে অনেক বিজ্ঞজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ইহাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভারতীয়দের পক্ষে প্রথম পাবলিক ভাষণ।’ প্রবন্ধটি বিখ্যাত পত্রিকা Quest-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘সিটি অব লাহোর’ নামের জাহাজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই দেশে ফিরেছিলেন সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের গভীর বন্ধুত্বে এই জাহাজযাত্রা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। সুকুমার রায়ের বিয়ে নিয়েও মজার ঘটনা আছে। বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের দিন হঠাত গেটের কাছে হইহই শুনে সকলে দেখলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত। এছাড়া একদল রক্ষণশীল গোঁড়া ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথকে ‘যথেষ্ট পরিমাণে’ ব্রাহ্ম বলে মনে করতেন না। এর উত্তরে সুকুমার রায় ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’ নামক একটি প্রবন্ধ লিখতে প্রশান্ত মহলানবিশ কে সাহায্য করেন, এবং ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি হিসেবে ভোটে জিততেও রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেন।
শান্তিনিকেতনের সঙ্গেও সুকুমারের ছিল আত্মীক সম্পর্ক। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় প্রতিদিন আলুর রান্না খেয়ে খেয়ে বিরক্ত সুকুমার মজা করেই গান বাঁধেন, “এই তো ভালো লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায়।” রবীন্দ্রনাথের গানে আসলে যে লাইনটা ছিল “এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।” রবীন্দ্রনাথও মজা করে সুকুমার রায়কে বলতেন, “সুকুমার তুমি যে লিখেছ, ‘ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগণে ধোঁয়া/ তিন ভাবে ডিসপেপসিয়া ঢেঁকুর উঠবে চোঁয়া’— আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছ কি?” ১৯২৩ সালে সুকুমার রায় অসুস্থ হলেন মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে। বাঁচার আশা নেই। শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে দেখতে চান। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। বন্ধুর অনুরোধে তিনি গান গেয়ে শোনান, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু।”
সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন মন্দিরে এক উপাসনার আয়োজন করেন। ভাষণে তিনি বলেন, “আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি এই কথাই বার বার আমার মনে হয়েছে। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো, অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখিনি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে”। …সেদিন সেই যুবকের মৃত্যুশয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের পরে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মতো অত বড়ো বিচ্ছেদকে, প্রাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে পেয়েছেন।”
Discussion about this post