আমাদের জানা অজানার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ হল ভিন্ন উপজাতির ধারক ও বাহক। রাভা তেমনই এক হারিয়ে যেতে চলা উপজাতি। পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, ভুটান, আসাম, মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে এদের দেখা মেলে। মূলত: উত্তর-পূর্ব সীমান্তের পার্বত্য পথ অতিক্রম করে মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত তারা। অল্প উচ্চতা, চ্যাপ্টা মুখ, হলুদ ত্বক, চোখে মঙ্গোলীয় ভাঁজ বিশিষ্ট এই উপজাতি ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেছে। প্রায় ২৭০০০ অধিবাসী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পূর্ব দিকে হিমালয়ের পাদদেশে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় এদের অবস্থান। পূর্ব ও পশ্চিম ডুয়ার্স হল তাদের চারণভূমি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের কোচ সম্প্রদায়ের বলেও পরিচয় দেয়।
বংশ পরম্পরাগত দিক অনুসারে রাভা সম্প্রদায় প্রকৃতিগত তত্ত্বে বিশ্বাসী। তবে বর্তমানে তাদের ধর্ম সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মের সাথে মিশেছে। এদের মধ্যে আবার বন্য রাভা ও গ্রাম্য রাভা এই দুই সম্প্রদায়ের দেখা মেলে। উভয় সম্প্রদায়েরই প্রধান উপাস্য দেবতা হল ঋষি বা মহাকাল।(সম্ভবতঃ শিব)। দেবী পার্বতী ও দেবী লক্ষ্মীকে প্রধান দেবী হিসাবে মেনে চলে সাথে চলে দেবী রুংতুক ও দেবী বাসেকের উপাসনা গৃহদেবতা রূপে। এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি বিশেষ আরাধনার রীতি হল মাটির ঘটের মধ্যে চাল দিয়ে তার ওপর একটি ডিম দিয়ে পুজো করা। বাড়ির বয়স্ক মহিলারাই একমাত্র এই পুজোর অধিকারী। এই পূজায় উপাস্যকে হাতে তৈরি সুরা নিবেদন করে ‘দেওসী’ উপাধীকারী পুরোহিত। দেবতাকে প্রসন্ন করার উদ্দেশ্যে পায়রা, শুয়োর প্রভৃতি দেবতাকে উৎসর্গ করে বলি দেওয়ার ও রীতি প্রচলিত। যা বিশেষত বন্য রাভাদের ধর্মপালনের সময় দেখা যায়। এছাড়াও নাচ, গান হল এদের উৎসব পালনের অন্যতম অঙ্গ।
পোশাকের মধ্যেও তারা দেখায় নিজস্ব শৈলী। পোশাকের সাথে ব্যবহার করে তারা মানানসই গহনা। রাভা মহিলারা বিভিন্ন উৎসব – অনুষ্ঠানে সোনা, রুপা, তামা,মূল্যবান পাথর, কয়েন প্রভৃতি দিয়ে তৈরি গয়না পরেন। গহনার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট মহিলারা তাদের সামজিক ও ব্যক্তিগত অবস্থান বোঝাবার জন্য বিভিন্ন ধরনের গয়না ব্যবহার করে। নাম্বরি, বালা-নাম্বরি, চন্দ্রহার, নাকা-পাতি, চান,বালি, হাত-বাজু,বান্টি, সিকি-সুকি, চাসি-তাম, রুবাক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গহনার প্রচলন রয়েছে।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজধারায় বিশ্বাসী রাভারা। তাদের জীবন যাপনের জন্য চাষবাস, বুনন ও বনভূমির ওপর নির্ভরশীল হলেও বুনন শিল্প রাভাদের অন্যতম প্রধান ও পরম্পরাগত একটি জীবিকা। আগে এরা স্থানান্তর কৃষির সাথে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারে দ্বারা এই কৃষি ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বনভূমির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পরে। স্হানান্তর কৃষি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ ও শিকার করাকেই তারা জীবিকা হিসাবে বেছে নেয় এই সমাজের পুরুষরা। শিকারী পেশায় তারা সিদ্ধহস্ত হলেও বর্তমানে শিকারের সাথে খুব কম সংখ্যক মানুষ যুক্ত। কেউ কেউ বাগিচা শ্রমকেও জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছে। রাভা নারীরা বুনন এর মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে সমস্ত রকম আধুনিক পেশায় তাদের অবস্থান লক্ষ্যণীয়। যেমন- শিক্ষাব্যবস্থা, সরকারী কাজকর্ম, সব্জি চাষ প্রভৃতি।
সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে রাভা উপজাতির মধ্যে আধুনিকতার প্রভাব বিস্তার করেছে। পরিবর্তন হয়েছে পেশা ও সংস্কারের, সাথে ধর্ম পালনের রীতির। বড়দিন বা দুর্গা পুজো তারই প্রমাণ। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ দিয়েছে তাদের পুরুষদের পোশাক নির্বাচনের জন্য স্বাধীনতা। বর্তমানে রাভারা আধুনিক শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে আধুনিক ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রতিবেদক স্বরণিকা মন্ডল
Discussion about this post