পুঠিয়া রাজবাড়ী বা পাঁচআনি জমিদারবাড়ী হচ্ছে বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম। তান্ত্রিক সাধক বৎসাচার্যের ছেলে পীতাম্বরকে সম্রাট আকবর বাংলাদেশের লস্করপুরের জমিদারি প্রদান করেছিলেন। পীতাম্বরের মৃত্যুর পর জমিদার হন তাঁর ভাই নীলাম্বর। এরপর থেকে নীলাম্বরের বংশ পুঠিয়ার রাজবংশ নামে পরিচিত। নীলাম্বরকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজা উপাধি দেন বলে শোনা যায়। তবে অন্য মত অনুযায়ী, দিল্লির সম্রাটের থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন নীলাম্বরের ছোটো ছেলে আনন্দরাম। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলায় এই রাজবাড়ি অবস্থিত।
রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের স্ত্রী মহারানি শরৎসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন বিদূষী নারী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎসুন্দরীকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন। তাঁর দত্তক নেওয়া ছেলে যতীন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে বিয়ে হয় হেমন্তকুমারী দেবীর। ১৮৯৫ সালে মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী তাঁর শাশুড়ি মহারানি শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানে তৈরি করিয়েছিলেন পুঠিয়ার এই বিখ্যাত রাজবাড়ি। ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে আয়তাকার দোতলা রাজবাড়ীটি নির্মিত। বাড়ির সামনে বারান্দা থেকে পেছনের বিশাল হলঘরে ঢোকার রাস্তা রয়েছে। গাড়ি বারান্দার সামনে রয়েছে দু’টি ঝুলবারান্দা। রয়েছে দোলমঞ্চ। কাছারির উত্তর দিকে একতলার ঘরটা ছিল ট্রেজারি অফিস। জমিদারের সঙ্গে প্রজারা যাতে দেখা করতে পারেন, তার জন্য একটা হলঘর তৈরি করা হয়েছিল। রাজবাড়ীর আশে পাশে ছয়টি রাজদিঘী আছে। প্রত্যেকটা দিঘীর আয়তন ছয় একর করে। মন্দিরও আছে ছয়টি। সবচেয়ে বড় শিব মন্দির। এ ছাড়া রানির স্নানের ঘাট, অন্দর মহল মিলিয়ে বিশাল রাজবাড়ী প্রাঙ্গণ এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।
এই বাড়ির আরেক নাম পাঁচ-আনি রাজবাড়ি। পাঁচ-আনি রাজবাড়ি থেকে একটু দূরে শ্যামসাগর দীঘির দক্ষিণপাড়ে রয়েছে চার-আনি রাজবাড়ি। এই বাড়িটার প্রধান ফটক এবং কাছারি আধভাঙা অবস্থায় থাকলেও বাকি অংশ এখন পুরো ভেঙে গেছে। পাঁচ-আনি রাজবাড়ির উঠোনে রয়েছে চৌকো আকারের গোবিন্দ মন্দির। মন্দিরের ঠিক মাঝখানে আছে গর্ভগৃহ আর চার কোণে চারটে ছোটো ঘর। মন্দিরে ঢোকার মূল রাস্তাটা পশ্চিমদিকে। দেওয়াল আর স্তম্ভে সাজানো রয়েছে দেবদেবী, ফুল, হাতি, ঘোড়া, শিকার, যুদ্ধ ইত্যাদির পোড়ামাটির সাজসজ্জা। বড়ো শিব মন্দির রয়েছে পুঠিয়া বাজারের শুরুতে শিবসাগর দীঘির দক্ষিণ পাড়ে। সিঁড়ি সহ মন্দিরের প্রধান দরজা দক্ষিণদিকে। বড়ো শিব মন্দিরের পূর্ব দিকে পুঠিয়া বাজারের মধ্যে রয়েছে চৌকো কাঠামোর চার তলা জগন্নাথ মন্দির বা রথ মন্দির। স্থানীয় মানুষ এই মন্দিরকে হাজারদুয়ারি নামে ডাকেন। লোকমুখে শোনা যায়, জমিদার ভুবেন্দ্রনারায়ণ তাঁর কিশোরী স্ত্রীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলার জন্য এই মন্দির বানিয়েছিলেন।
মুঘল আমলে বাংলার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পুঠিয়া জমিদারি অন্যতম প্রাচীন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা বজায় ছিল। প্রথা বিলুপ্ত হলে পুঠিয়া রাজবাড়ীর জমিদারিও বিলুপ্ত হয়। ১৯৭৩ সালে পুঠিয়া রাজবাড়িতে চালু হয় ডিগ্রি কলেজ, এখন যেটা লস্করপুর ডিগ্রি বিদ্যানিকেতন নামে পরিচিত। তবে জমিদারি বিলুপ্ত হলেও সে আমলে নির্মিত তাদের প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ঠিকই এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।
Discussion about this post