শহরতলি আর গ্রামবাংলার পার্থক্যটা বেশ চোখে পড়ে। বড় বড় শপিং মল, উঁচু উঁচু বাড়ি দেখা শহুরে চোখ একরকম ক্লান্ত। ঠিক তখন বাংলা আশ্রয় খোঁজে লতাপাতায় মোড়া শান্ত ছাউনিতে। বাংলার আসল রসদ তো গ্রাম বাংলার মেঠো সুরেই লেগে রয়েছে। পল্লিগীতি, বাউল গান, একতারা এসবের সংস্পর্শ একবার যে পেয়েছে; ভুলতে পারেনি। সেই বাউলের আঁতুড়ঘর, শান্তির নিবাস শান্তিনিকেতন। যেখানে আজও দু্র্গোৎসবকে ছাপিয়ে চলে গ্রাম বাংলার পুরনো মেলা। আশা করি, বুঝতেই পারছেন কোন মেলার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে! ঠিক ধরেছেন, পৌষমেলা! যার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকে গোটা বাংলা। অপেক্ষা চলে বিদেশী দেশী বহু ভ্রমণকারীর পদধূলির। বিশ্বজোড়া সুনামের মুকুট মাথায় এই মেলার। কিন্তু এই পৌষমেলার উৎপত্তির গল্পটা হয়ত অনেকটা অজানাই। তাই আজ পৌষমেলার কিছু অচেনা ইতিহাসের সাথে পরিচয়টা সেরে ফেলা যাক।
ঊনবিংশ শতাব্দী। বাংলায় তখন ধর্ম আন্দোলনের প্লাবন বইছে। বাংলার নবজাগরণে ব্রতী হচ্ছেন বহু শিক্ষিত সম্প্রদায়। গড়ে উঠল নতুন সমাজ, ব্রাহ্মসমাজ। যুক্তির উপর নির্ভর করে হিন্দু ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতিগুলির সংস্কারই এঁদের মূল উদ্দেশ্য। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে দীক্ষিত হলেন এই ব্রাহ্মধর্মে। সময়টা ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ। আর সেই উপলক্ষ্যেই ১৮৪৩ সালে বসে এক মেলা। ৩ দিন ব্যাপী এই মেলার আয়োজন হল ভুবনডাঙার মাঠে।
আবার ১৮৯১-র ৭ পৌষ শান্তিনিকেতনে তৈরী হয় ব্রাহ্মমন্দির। ১৮৯৪ সালে ঐ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসে মেলা বসল মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকের মাঠটিতে। সেই থেকেই শান্তিনিকেতনে সূচনা হয় ঐতিহ্যশালী পৌষমেলার। পরে অবশ্য মেলাটি আকার আয়তনে বেশ বড় হয়েছে। এখন গোটা শান্তিনিকেতন জুড়েই চলে মেলার বাজার। এমনকি জায়গাটিও স্থানান্তরিত। ১ পৌষ শুরু হয় উৎসব আর হিসেব মতো ৭ পৌষ মেলা। ভোর চারটে, ছাত্রছাত্রীরা উপাসনাগৃহে জড়ো হয় উপাসনার জন্য। বৈতালিক গান গেয়ে চলে মন্দির পরিক্রমণ। এরপর ছাতিমতলায় উপাসনার আয়োজন করা হয়। উপস্থিত সবাই গান গাইতে গাইতে উত্তরায়ণে অংশ নেন।
এবার চলুন দেখি কী কী থাকে এই মেলায়। এখানের সর্বাপেক্ষা মনকাড়া জিনিস হল পোড়ামাটির হস্তশিল্প। একতারা, মাটির পুতুল, কাঁথা স্টিচের পোশাক। এক কথায় গ্রাম্য কুটিরশিল্পের প্রদর্শনী চলে ওই মেলা কটা দিন। আর ক্রেতাদের মনে সুখ দিতে বাউল গান, ছৌনাচ, লোকসঙ্গীতের ঠেক বসে। পেটপুজোর জোগাড়ের জন্য খাবার দোকানও বিস্তর। প্রায় ১৩০০ মতো স্টল বসে এই মেলায়। মেলা উপলক্ষে তিন দিনে প্রায় ১০,০০০ পর্যটক সমাবেশ হয়। তবে এবছর অতিমারির কবলে পড়েছে মেলাটিও। উৎসব উপাসনা হলেও মেলাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বাঙালি উদ্যম হারায়নি এখনও। অধীর আগ্রহে পরের বছরের পৌষমেলায় দ্বিগুণ আনন্দে মেতে উঠতে অপেক্ষায় সবাই।
Discussion about this post