প্রাক স্বাধীনতা আমলে, মধুসূদন দাসের হাত ধরে মুর্শিদাবাদ জেলার খাগড়া তথা বহরমপুর অঞ্চলে মৃৎশিল্প কাজের রূপ পায়। মধুসূদন যদিও এই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন না। জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের ছোট্ট গ্রাম গোকর্ণ থেকে এই অঞ্চলে আসেন মধুসূধন। বর্তমানে তাঁর চতুর্থ প্রজন্ম ও তাদের পরিবার খাগড়ায় (সৈদাবাদ অঞ্চলে) বসবাস করেন। তাঁরা প্রায় সকলেই পেশা হিসাবে মাটির কাজই বেছে নিয়েছেন। কেউ মূর্তি তৈরিতে দক্ষ কেউ বা মাটির ভাস্কর্য তৈরিতে পটু আবার কেউ জেলায় বিখ্যাত হয়েছেন ‘ভৈরব’–এর মায়াময় মূর্তি তৈরি করে। মধুসূদনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি প্রথম জীবনে কাঠের কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি মাটির কাজ শুরু করেন। তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক দক্ষতাবলে এই এলাকায় মাটির কাজের পসার লাভ করেন।
পূর্বে এই অঞ্চলের রাজবাড়ির চাহিদা অনুযায়ী মূর্তি, মাটির প্রতিমা তৈরির জন্য মুর্শিদাবাদের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত গ্রাম মহুলা থেকে শিল্পী নিয়ে আসা হত রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতেই দিনের পর দিন থেকে তারা কাজ করতেন। প্রাচীন মৃৎশিল্পীরা নিজেদের মনের রসনাকে মাটির আকারে রূপ দিতেন। কখনও তা হয়ে উঠত ছোট্ট পুতুল বা কখনও বড়ো মা কালির মূর্তি। তারপর মূর্তি পুজো রাজবাড়ি , জমিদার বাড়ির বাইরেও হতে শুরু করল, পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হল। মাটির কাজের চাহিদা বাড়ল, মৃৎশিল্পীরও চাহিদা বাড়ল স্বাভাবিক ভাবেই। সেই সময় গোকর্ণ থেকে কাজের আশায় বহরমপুর এলেন মধুসূদন দাস। নাম ডাক হওয়ার পর তিনি খাগড়া অঞ্চলে মাটির কারখানা স্থাপন করেন। তাঁর চার সন্তান ছিল, এছাড়াও ছিল অসংখ্য অনুরাগী কারিগর। পরে তারা ছড়িয়ে পড়েন বহরমপুর তথা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। নিজেদের কারখানা তৈরি করে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে থাকেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও আজ মৃৎশিল্পী হিসাবে স্বমহিমায় রাজত্ব করছেন।
একালের বহরমপুরের প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী যামিনী পালের পৌত্র অসীম পাল। মাটির প্রতিমা নির্মাণে আজ দেশজোড়া তাঁদের নামডাক। শোনা যায়, এই যামিনী পালের পিতা শ্রী ভজহরি পাল। তাঁর মাটির কাজের হাতেখড়ি হয় মধুসূদনের তৃতীয় পুত্র ঋষিকেষ দাসের হাতে। আশুতোষের পুত্র ছিলেন শীতল দাস (শীতল মিস্ত্রী নামে যিনি সৈদাবাদ এলাকায় পরিচিত)। সৈদাবাদ জোড়াশিব মন্দিরের গায়ে লাগা শীতল মিস্ত্রির কারখানা এখনও আছে। শীতল পুত্র শীর্ষেন্দু দাস ও আরও অনেকে এখনও সেই কারখানাতেই কাজ করেন। অনেকেই আসেন এখানে দিনের শেষে এই আখড়ায়।
সবাই যে শুধু নিজের আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্য আসেন তা নয়। খাগড়া অঞ্চলে এখনও এরকম মৃৎশিল্পীরও সন্ধান মেলে যারা সারাদিনের চাকরির পরও সময় বের করে এই কারখানায় আসেন একটিই কারণে। শুধুমাত্র নিজের হাতে মাটিকে মনের মতো রূপ দেবেন বলে। এটাই তাদের নেশা। এরকমই একজন সোমনাথ চৌধুরী, পেশায় বহরমপুর আদালতের কর্মচারী। তাঁর মাটির কাজের প্রতি টানের একমাত্র কারণ শীতল কাকা (শীতল মিস্ত্রী)। তাঁর কথায়,“খাগড়ায় শীতল কাকার থেকে বড় শিল্পী নেই, হবেও না। শীতল কাকা আমাদের শিখিয়ে ছিলেন মাটি হল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। মাটি আমরা সর্বত্র দেখতে পাই, তাই কদর করিনা। তবে আমরা যারা মাটির কাজ করি মাটি আমাদের কাছে ভগবানের উপহার। তাই যখন কিছু ভালো লাগে না, একতাল মাটি নিয়ে বসলে সব ঠিক হয়ে যায়।” শীতল দাস নেই আজ অনেক বছর, কিন্তু তাঁর স্মৃতি এখনও তাঁর ভক্তদের কাছে অমলিন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন শিল্পী ও দার্শনিক।
শীতল মিস্ত্রীর অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যেও অন্যতম একজন ভক্ত হলেন, পোড়ামাটির ভাস্কর্য শিল্পী শ্রী মহাদেব দাস। শীতল দাস (শীতলকাকা) কে তিনি আজও গুরু মানেন। আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে সৈদাবাদ জোড়াশিব মন্দিরের পাশে শীতল মিস্ত্রীর কারখানায় হাতেখড়ি হয় মহাদেবের। তারপর সেই শুরু, মাটি মহাদেবকে কখনও ছেড়ে যায়নি। মহাদেবের কাছেও মাটি ভগবানের আশীর্বাদ। মহাদেবের এই কাজের পেছনে রয়েছে বৌদ্ধিক মতাদর্শ ও শিল্পবোধ। মহাদেব পুরনো দিনের স্মৃতিচারণে বলেছেন – “কারখানায় যখন কাজ শুরু করি, তখন কচি বয়স। আর আজ আমি ষাট পেরিয়ে গেছি, আমার হাতে শীতলকাকা মাটি দিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, সে মাটি আজও লেগে আছে।” হাল আমলে বহরমপুর তথা সারা জেলা থেকে আসছে প্রচুর কাজের অর্ডার। জেলা এমনকি রাজ্যের বাইরেও যেতে হচ্ছে মূর্তি তৈরির কাজে। কারখানার শিল্পীরাই ছিল তাঁর পরিবার, বৃহত্তর পরিবার।
দিন পেরিয়েছে, বছর পেরিয়েছে। ২০০০ সালের বন্যার পর, মহাদেব গঙ্গা তীরে নিয়াল্লিশপাড়ায় নিজের পরিবার নিয়ে বাস শুরু করেন। তিনি এখন বড় মূর্তি নির্মাণের কাজ আর করেন না। বরং মনোনিবেশ করেছেন পোড়ামাটির ভাস্কর্য নির্মাণে। স্বাধীনভাবে নিজের ছোট্ট ঘরেই গড়ে তুলেছেন কারখানা। সেখানে তিনি আর তাঁর স্ত্রী দুজন মিলেই মাটিতে হাত লাগান। তাদের ঘরে রয়েছে মাটি পোড়ানোর উনুন। সারাদিন মাটি নিয়েই থাকেন এই দম্পতি। মহাদেব দাস, বিশেষভাবে এই পোড়া মাটির ছোট মূর্তি বা বিভিন্ন ভাস্কর্য তৈরি নিয়ে বলেন –“বড়ো কাজ আগে করেছি প্রচুর, বড়ো কাজেই হাত পাকিয়েছি নিজের। কিন্তু বড়ো কাজ করা ছেড়েছি কারণ, ওই কাজ করার এখন মেলা লোক, আর অর্ডার ছাড়া বড় কাজ করা যায় না। আমার কাছে অর্ডার আসে না বলে কি কাজ করব না? তার চেয়ে ছোট কাজ অনেক বেশি স্বাধীনভাবে করা যায়। কোন চাপ থাকে না, সময়ও লাগে বড় কাজের থেকে অনেক কম। ছোট কাজই করতে চাই বাকি জীবন, ছোট কাজ ভগবানের কাজ।”
মহাদেবের বয়স এখন ষাট ঊর্ধ্ব। তবুও বয়সকে হার মানিয়ে নিজের তৈরি মূর্তি বিক্রি করতে তাঁকে যেতে হয় ১০০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগরে মুক্তি পাল, কার্ত্তিক পাল (কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী, মৃৎশিল্পের মহাজন) এঁদের কাছে। মহাদেব ও তাঁর পরিবারের আক্ষেপ আছে। তাঁরা মাটির কাজ করে বলে তাদের কদর নেই। মহাদেব বলেন, সোনার কাজ করলে হয়তো তাদের কদর বেশি হতো, টাকাও। তিনি আরও বলেন, কিন্তু কাজ তো কাজই, সোনা হোক বা ব্রোঞ্জ বা রুপো — আকার তো প্রথমে মাটিতেই দিতে হবে। আগে লোকের ঘরে মাটির পুতুল শোভা পেত, এখন তার জায়গা নিয়েছে ফাইবার, কাঁচ, প্লাস্টার। আর মাটির পুতুল ছাঁচে ফেলে আকার দেওয়া খুব সহজ ফলে কাজ চুরির প্রবণতাও আছে। শুধু তাই নয় মাটি বলেই সরিয়ে দেয়, কাজ দেখে না। বলে, মাটির জিনিসের এত দাম! আমাদের কাজের মজুরি নাই। মহাদেব দাস ও এখানকার অন্যান্য ছোট মৃৎশিল্পীদের দাবী – তারা যাতে তাদের পরিশ্রমের মজুরি পান।
সরকারীভাবে হস্তশিল্পের মেলা, হাট এই জাতীয় ব্যাবসায়িক উদ্যোগ নিলে, তাদের ঘরে খানিক টাকা আসে। অতিমারী পরবর্তী পৃথিবীতে তাদের অবস্থা শোচনীয়। বহরমপুরের সবচেয়ে কাছাকাছি মৃৎশিল্পের একমাত্র বাণিজ্যস্থল কৃষ্ণনগর, তাও প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। কাজ বিক্রি হয় একদামে, তা হস্তান্তর হয় আরেক দামে। কাজের সঠিক দাম পান না শিল্পী। এই অবস্থার প্রতি তাঁরা ক্ষুব্ধ এবং একই সঙ্গে আশাহত। মহাদেব দাসের পরিবারে তিনিই এই কাজের শেষ প্রজন্ম। ইতিহাস মুছে যাবার দিকে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি সবক্ষেত্রেই। মৃৎশিল্পও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবুও শেষে মনে করা প্রয়োজন শুধু মৃৎশিল্পী নয়, যে কোনো হারিয়ে যাওয়া শিল্প ও শিল্পীর পাশে থাকা নাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্য।
প্রতিবেদক দেবনীল সরকার
Discussion about this post