বাঁকুড়ার রাইপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম সহজপুরের বাসিন্দা পূর্ণিমা দত্ত গত ৮ ডিসেম্বর ৫৬ বছর বয়সে মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় এক মাস আগে তিনি কলকাতার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্বার্থে এসএসকেএম হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগে দেহদান করেন। দীর্ঘ চার দশকের বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী পূর্ণিমা দত্ত একজন নারী আন্দোলনের কর্মী ছাড়াও কুসংস্কার, ভেদাভেদ বিরোধী বিজ্ঞানমনস্ক সমাজকর্মী ছিলেন। সাক্ষরতার প্রসারে এবং আদিবাসী ভাষা আন্দোলনেও তিনি সামিল হয়েছিলেন।
শ্রাদ্ধ-শান্তির বিপরীত স্রোতে গিয়ে প্রয়াত মায়ের আদর্শে বড় হওয়া মেয়েরা সিদ্ধান্ত নেন ওনার স্মরণে গ্রামেই রক্তদান শিবির করবেন। ৩০ ডিসেম্বর সহজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেই শিবির হয়। পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়াও হুগলি, বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম, কলকাতা থেকে আগত শুভানুধ্যায়ীরাও রক্তদান করেন। ৯ জন মহিলা সহ মোট ৭১ জন রক্তদান করেন ‘গ্রামের প্রথম রক্তদান শিবিরে’। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ‘প্রথম রক্তদাতা’। রক্তদাতাদের হাতে উপহার স্বরূপ তুলে দেওয়া হয় হরেক রকমের চারাগাছ। এছাড়াও উনার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রায় তিন শতাধিক গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শীতবস্ত্র দেওয়া হয়। গ্রামের বাসিন্দা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর দাদু তুলসী দত্ত জানান “এই রক্তদান শিবির থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের আশার আলো দেখাবে।”
লক্ষীকান্ত বরাট, পিনাকী মন্ডল একই সুরে জানান “আশাতীত ভাবে প্রায় চল্লিশ জন রক্তদাতা প্রথমবার রক্তদান করলেন। এই শিবির রক্তদান এবং দেহদানে স্থানীয় গ্রামবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, সন্দেহ নেই।” কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের কর্মী সৌরভ দত্ত মরণোত্তর দেহদান নিয়ে বক্তব্য রাখেন, পনেরো জন গ্রামবাসী তাঁর কাছ থেকে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ করেন।
মৃত্যুর ২০ দিন পরেও সহজপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে আগত বাসিন্দারা পূর্ণিমা দেবীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সুখ-দুঃখে থাকা নিজেদের কাছের মানুষ চলে যাওয়ায় তাঁরাও নিজেদের সামলে রাখতে পারেন নি। আর তা হবে নাই বা কেন! আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনের সাথে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক রাখায় তাঁর পরিবারকে প্রায় একঘরে রাখা হয়েছিল। কিন্ত সাহসী ও তেজস্বী মহিলা লড়াই ছাড়েননি, প্রতিক্রিয়াশীলের আক্রমণে কখনোই নতিস্বীকার করেননি। পাশে পেয়েছিলেন স্বামী কল্পতরু দত্ত এবং তিন মেয়েকে। পণপ্রথা,বাল্যবিবাহ, কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে আমৃত্যু তিনি লড়ে গিয়েছিলেন বলেই সহজপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে আগত সাধারণ গ্রামবাসীরা স্বেচ্ছায় রক্তদানের পাশাপাশি মরণোত্তর দেহদানেও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। গ্রামগুলোতে জাতিগত ভেদাভেদও অনেকটা কমেছে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে তিন কন্যা সোমা, সীমা এবং রুমা জানান “গ্রামবাসীদের এই স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে আমরা অভিভূত। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার হোক, আরো বেশি করে রক্তদান-মরণোত্তর দেহদান হোক, তাহলেই মা বেঁচে থাকবেন এই সমাজে।”
প্রতিবেদক রাকেশ মুদলী
Discussion about this post