বিগত একটি দশকে আমাদের জীবনে বদলের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পাঁচশো আর দু’হাজারের নোট বাতিল হয়ে আবার নতুন অবতারে ফিরে এসেছে, এনআরসির বিরুদ্ধে সারা দেশ উত্তাল হয়েছে এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার গোটা পৃথিবী একসঙ্গে ঘরবন্দী জীবন কাটিয়ে ফেলেছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পেশাদারি জীবন, বদলের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্রই। তবে একটি ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তা হল বাংলা সিরিয়াল। এক বাক্যে বলতে গেলে, দশ বছর আগে বাংলা সিরিয়াল যতটা সামন্ততান্ত্রিক, পশ্চাদমুখী এবং কুসংস্কারে ঠাসা ছিল এখনও তাই আছে।
গত দশ বছর ধরে টিআরপির প্রথম সারিতে উঠে আসা বাংলা সিরিয়ালগুলির দিকে নজর দিলেই চোখে পড়বে, কিছু ব্যাতিক্রম বাদ দিলে সব গল্পেই নায়িকারা প্রায় একই ছাঁচে গড়া। এঁদের মধ্যে কেউ পড়াশোনায় তুখোড় কেউ আবার অসাধারণ কথ্থক নাচেন। কিন্তু, এই সমস্ত কিছুতেই ইতি পড়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে যখন দৈবযোগে নায়কের হাতের ঠেলায় এক খাবলা সিঁদুর তুষারপাতের মতো উড়ে এসে নায়িকার মাথায় পড়ে। এরপরেই শুরু হয় বিবাহিত জীবনের ইনিংস থুড়ি নায়িকাটির অতিমানবী হয়ে ওঠার লড়াই। একদিকে সিরিয়ালের ‘আদর্শ নারী’টি স্বামীরত্নটির মন পাবার জন্যে একের পর এক অগ্নিপরীক্ষা দিতে থাকে আর অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির শত্রুপক্ষ নায়িকাকে অপদস্থ করার জন্যে নানান ষড়যন্ত্র সাজাতে থাকে। কিন্তু, মুখ্যভূমিকায় থাকা বধূমাতাটি নিজের বিরুদ্ধে হওয়া যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখটি বুজে চুপটি করে থাকে।
যে পৃথিবীতে মেয়েরা প্রতিদিন নিত্যনতুন প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙোচ্ছে, সেই পৃথিবীর সঙ্গে বাংলা সিরিয়ালের কনটেন্ট এতটা বেখাপ্পা কেন? কেন সেখানে প্রোটাগনিস্ট চরিত্রটির উপর সব পারার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় অথচ তাকে পুরুষের ছায়া থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না? কেন সেখানে মুখ্য পুরুষ চরিত্রটির করা একের পর এক অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়? এর উত্তরে নির্মাতারা বহু বছর ধরে অজুহাত হিসেবে শুনিয়ে আসছেন, ‘বাজার এটাই খায়’। কিন্তু, বাজারের এহেন অস্বাস্থ্যকর খিদে কিন্তু টেলিভিশন জমানার শুরু থেকেই ছিল না। বাঙালির ড্রয়িং রুমে টেলিভিশন বিপ্লব শুরু হওয়ার পর, প্রথম দুটি দশকে এমন বহু সিরিয়াল রমরমিয়ে চলেছিল যেগুলিতে টানটান গল্প থাকলেও গল্পের গরু গাছে উঠত না। মূলত হিন্দি সিরিয়ালের সাথে বাজারি টেক্কা দিতে গিয়েই বাংলা টেলি ধারাবাহিকের পথ হারানোর শুরু।
অথচ দর্শক কিন্তু বারেবারে প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা ভালো কাজের মান রাখতে জানেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এক দশক আগে টিআরপির প্রথম সারিতে থাকা সুবর্ণলতার কথা। চিত্রনাট্যে কিছুটা বদল আসলেও সুবর্ণলতার নির্মাতারা আশাপূর্ণার দেবীর উপন্যাসের মর্মবস্তু থেকে সরেননি। দর্শকেরা কিন্তু সিরিয়ালটিকে ঢেলে সমর্থন করেছিলেন। সম্প্রতি ডাক্তার কাদম্বিনী বসুর জীবন অবলম্বন করে তৈরি ‘প্রথমা কাদম্বিনী’ ‘সিরিয়ালটিও দর্শকদের অনেকের কাছেই সমাদর কুড়িয়েছে। এখনও বাংলার মেয়েদের এক বড়ো অংশের অবসর কাটে সিরিয়াল দেখে। মায়ের দেখাদেখি অনেক সময়েই বাড়ির ক্ষুদে সদস্যটিও বসে যায় সিরিয়ালের সামনে। সুতরাং, সমাজে এই সিরিয়ালগুলির কুপ্রভাবের আশঙ্কা নেহাত কম নয়। সেই কারণেই এই সাংস্কৃতিক দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ভীষণ জরুরি। এক্ষেত্রে, সামাজিক আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি প্রতিবাদের প্রত্যাশা সেই সমাজসচেতন দর্শকদের কাছেও যাঁরা এখনও সুস্থ রুচির মনের খোরাক খোঁজেন।
Discussion about this post