“ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ; কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা; সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া; সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া….” জসীমউদ্দিনের ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় তিনি বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আমেজকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাল আমলে এই ‘নীল নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ’ নগর উন্নয়নের সাথে সাথে কংক্রিটের ভিড়ে চাপা পড়েছে। নীল আকাশ ঢেকেছে কালো ধোঁয়ায়, কংক্রিটে মুড়েছে রাস্তাঘাট, বড়ো বড়ো ফ্ল্যাট বাড়ির ছায়ায় হারিয়েছে প্রকৃতির মাধুর্য।
কংক্রিটের রোষ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে আজও কিছু এলাকা। সংখ্যায় খুব কম হলেও আজও তারা বর্তমান। তেমনই এক জায়গা পোচমপল্লি গ্রাম। হায়দ্রাবাদের একেবারে কাছে ভূবনগিরি জেলার এটি ছোট্ট একটি গ্রাম যা আজও প্রকৃতির সারল্যকে অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। শহরের ইট কাঠ পাথরে হারিয়ে যায়নি সে। আজও সে নিজেকে আগলে রাখার লড়াই লড়ছে। গ্রামটি কিন্তু প্রকৃত অর্থে ছোট। মেরে কেটে ৭০০ জন লোকের বাস। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয় এই গ্রামটি আরও দুটি কারণের জন্য বিখ্যাত এক ভূদান আন্দোলন আর দুই শাড়ি। বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের কয়েক বছর পরই এই গ্রামে শুরু হয় ভূদান আন্দোলন। ১৯৫১ সালে বিনোবা ভাবের নেতৃত্বে জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে কৃষকরা। জমিদারদের অত্যাচার সফল ভাবে দমন করে কৃষকরাজ চালু হয় এখানে। সেই আন্দোলন পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বহু জায়গায়।
পোচমপল্লির নিজস্ব ঘরানার শাড়ি বিখ্যাত সারা ভারত জুড়ে। এখানে তাঁত থেকে সরাসরি শাড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন তাঁতিরা। দামেও কিন্তু বেশ সস্তা পড়ে। এখানে সকলেই ‘মদন তাঁতি’। হায়দ্রাবাদে বেড়াতে গিয়ে শাড়ি-প্রিয়রা এই গ্রামে একবারও ঢুঁ মারেননি এমনটা হতে পারে না। এখানকার তাঁতে তৈরি ইক্কত শাড়ি খুবই জনপ্রিয়। দামি থান কাপড় ছাড়া তাঁতিরা এখানে তাঁত বোনেন না। শাড়ি বিক্রি করে বছরে প্রায় দশ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই গ্রামে। প্রকৃতির চাদরে মোড়া তেলাঙ্গানার এই ছোট্টো গ্রামটিই পেতে পারে বিশ্বের সেরা গ্রামের তকমা। UNWTO-র সেরা গ্রামের প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই আশার বুক বেঁধেছেন গ্রামের বাসিন্দার। গ্রামের সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা, শিল্প এবং শিল্পীদের বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পেরে খুশি তারা।
দিজেন্দ্রলাল রায়ের কথায় “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি৷” বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এক অন্যতম নিদর্শন আমাদের দেশ। আর তাকে সম্পূর্ণ করে এই সব গ্রামগুলো। যা আজও প্রকৃতির প্রাণ বায়ুকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম৷ আর আশা করা যায় ভবিষ্যতেও এই গ্রামগুলো দেশের বৈচিত্রকে একই ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভারতকে মেলে ধরবে গোটা পৃথিবীর সামনে।
Discussion about this post