নতুন কোনো ঝড় আসছে, তৈরি হচ্ছে ঘূর্ণাবর্ত কিংবা বর্ষা বাংলায় ধুকে পড়েছে শুনলেই শহুরে মানুষের মন কেমন নেচে ওঠে না? শুরু হয় বৃষ্টির খাওয়াদাওয়ার প্ল্যানিং, ডে আউট- নাইট আউটের প্ল্যানিং এবং আরো কত কী! এই আনন্দের সময়গুলোয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কেমন অবস্থা হয়, কখনও ভেবে দেখেছেন? যাঁদের মাথার উপর নেই শক্তসমর্থ ছাদ, নেই চাষের জমি, নেই খাবার। আছে শুধু বেঁচে থাকার লড়াইটুকু। আনন্দের মত বিলাসিতার সময় তাঁদের নেই। কলকাতায় এখন বর্ষার ঘনঘটা। সুন্দরবনেও হচ্ছে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির সঙ্গেই যখন ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’র মত আসেন বনবিবির বাহন, তখন এই বৃষ্টি মোটেই সুখকর হয়না বলাই বাহুল্য !
প্রস্তরযুগে মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ভয় পেত, সম্ভ্রমের চোখে দেখত। প্রকৃতিকে শান্ত করার জন্য করত পুজো। সুন্দরবনের মানুষও বাঘকে তেমনি ভয় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। সুন্দরবন অঞ্চলে অসংখ্য ওঝা বাঘ বশীভূত করার কাজ করেন, এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বাঘবন্ধ’। রয়াল বেঙ্গল টাইগারের বুদ্ধি, চাতুর্য, মানুষের মতিগতি সম্পর্কে জ্ঞান এদের সাক্ষাৎ দেবতা বা সাক্ষাৎ শয়তানের জায়গায় বসিয়ে রেখেছে। মানুষ হয় সম্ভ্রমে কপালে হাত ঠেকায়, আর নয় ভয়ে কাঁপে। ফলে বাউলে, মৌলী, জেলেরা বাবা দক্ষিণরায়, বনবিবি, কালু খাঁ, শা জঙ্গলী, গাজি সাহেব প্রভৃতির পুজো করে থাকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না। যেমন হয়নি রবি মজুমদারের মত মানুষদের।
রবি মজুমদার জঙ্গলে গিয়ে পরেছিলেন বাঘের মুখে। বাঘ তাঁর মাথাটা মুখের ভেতর কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। খালি হাতেই কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন। চারমাস হাসপাতালে থাকার পরে তাঁর মুখের একটি দিক ক্ষতবিক্ষত, ভাঙা। একটি চোখ গেছে নষ্ট হয়ে। জীবন নির্বাহ করবার জন্য নেই ন্যুনতম কর্মসংস্থান। আয়লার সময় জমি, বাড়ি শেষ হয়ে গেছে। পরের বছরগুলিতেও এসেছে বুলবুল, আম্ফান। ঝড়খালির নিরঞ্জন হালদারের গল্পও কিছুটা এমনই। সংসারে প্রচন্ড অভাবের তাড়নায় মাছ ধরতে গিয়ে তিনি পড়েন বাঘের মুখে। ঘাড় ও কাঁধ আজও ঠিক হয়নি। দীনবন্ধু মণ্ডলের বন্ধুরা লাঠি দিয়ে তাড়া করে তাঁকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। মধু কাটতে যাওয়া রমেন মিস্ত্রিকেও বাঘ থাবা মেরেছিল। দেহে তাঁর বিরাশিটা সেলাই।
এমনই অজস্র গল্প উঠে আসবে সুন্দরবনের মানুষদের মুখে। এতকিছুর পরেও বাস্তব বড় ভয়ানক। দেহে জীবন-মৃত্যুর প্রাণপন লড়াইয়ের চিহ্ন নিয়ে তাঁরা আবার জঙ্গলে যান। ভক্তিভরে বনবিবি বা দক্ষিণরায়ের পুজো দেন। কেউ কেউ আতঙ্কে ঘরের অন্ধকারে সেঁধিয়ে থাকেন। তাঁর ছেলে যায় জঙ্গলে। হয়ত ফিরে আসে, হয়ত ফিরে আসেনা। আর আমরা শহুরে মানুষেরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের ‘সেফ মার্ক’ করি।
চিত্রঋণ – সুদীপ সিনহা
Discussion about this post