ঝাড়গ্রাম জেলার শিলদার কাছে ওড়গোন্দা গ্রামে প্রতিবছর বিজয়া দশমীর পরের দিন শুরু হয় এক অনন্য উৎসব পাঁটাবিন্দা মেলা। এটি শুধু একটি বেচাকেনার মেলা নয়, বরং আদিবাসী সমাজের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধনের এক বৃহৎ প্রতিফলন। মেলাকে ঘিরে গোটা অঞ্চল জেগে ওঠে উৎসবের আবহে। মানুষের কোলাহল, মাদলের তালে নাচ, আর সাঁওতালি গানের সুরে এই মেলা যেন রূপ নেয় এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রে। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার এমনকি দেশের বাইরে থেকেও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে মিলিত হন। ফলে এই মেলা এখন আন্তর্জাতিক সাঁওতাল সমাজের মিলনমেলা হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।

তবে শিলদা পাঁটাবিন্দা মেলার সবচেয়ে আলোচিত আকর্ষণ নিঃসন্দেহে আদিবাসীদের হাতে তৈরি মাংস পিঠে। স্থানীয় মহিলাদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি এই ঐতিহ্যবাহী খাবার মেলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। নরম খামিরের আস্তরণের ভেতরে থাকে মশলাদার মাংসের পুর, যার স্বাদ, ঘ্রাণ ও ঝাঁজ মিলে তৈরি করে এক অমোঘ প্রলোভন। দর্শনার্থীরা সার বেঁধে দাঁড়ান কেবল এই মাংস পিঠের স্বাদ নিতে। অনেকের মতে, “পাঁটাবিন্দা মেলায় এসে মাংস পিঠে না খেলে মেলাটা যেন অসম্পূর্ণ।” এই বিশেষ খাদ্যপদ শুধু স্বাদেই নয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক হিসেবেও সাঁওতাল সমাজের গর্ব বহন করে।

এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ আদিবাসী সমাজের তৈরি নানান হস্তশিল্প, কৃষি উপকরণ, পোশাক, অলঙ্কার, বাসনপত্র, বাদ্যযন্ত্র ও গৃহস্থালির সামগ্রী। প্রতিটি জিনিসে ফুটে ওঠে সাঁওতাল শিল্পীর সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া। পাঞ্চি শাড়ি, ধুতি, তীর-ধনুক, বাঁশি, মাদল, ধমসা, ঢোল – সবকিছুই এখানে পাওয়া যায়। এগুলো শুধু ব্যবহারিক বস্তু নয়, আদিবাসী জীবনধারার বহিঃপ্রকাশ। মেলার মাঠে দেখা যায় লোকনৃত্য, সাঁওতালি গান, গল্প বলার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, যা মেলাটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি যেমন সক্রিয় হয়, তেমনি আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণে এই মেলার ভূমিকা অনন্য।

সব মিলিয়ে পাঁটাবিন্দা মেলা আজ কেবল একটি আঞ্চলিক উৎসব নয়, বরং আদিবাসী সংস্কৃতির এক জীবন্ত ইতিহাস। এখানে যেমন দেখা যায় শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও খাদ্যের সমৃদ্ধ সমাহার, তেমনি অনুভূত হয় সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এই মেলা প্রমাণ করে, আধুনিকতার ঢেউয়ের মধ্যেও আদিবাসী ঐতিহ্য এখনও বেঁচে আছে তাদের মাটি, গান, নাচ, আর জীবনের ছন্দে। ঝাড়গ্রামের এই মেলাই যেন সেই সংস্কৃতির রঙিন প্রতীক, যেখানে মিলেমিশে একাকার হয় স্বাদ, শিল্প, ঐতিহ্য ও মানুষ।
চিত্র ঋণ – সাঁওতাল হোপান
Discussion about this post