বাংলার জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোগুলো একসময় আভিজাত্য, ঐশ্বর্য এবং সামাজিক সম্মানের প্রতীক ছিল। জমিদারি প্রথার অবসান ঘটলেও, এইসব পুজোগুলোর ঐতিহ্য এখনো অনেক জায়গায় টিকে আছে। সময়ের সাথে সাথে পুজোর সেই জৌলুস হারিয়ে গেলেও আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অটুট রয়েছে। জমিদার পরিবারের ধর্মীয় সংস্কৃতির এই অঙ্গনগুলোই গ্রামীণ জনগণের কাছে একটা সময়ে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে জমিদারি পুজোগুলো এখন কেবল স্থানীয় ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে পালিত হয়, যেখানে আড়ম্বর কমলেও সেখানকার মানুষের আবেগ এবং নিষ্ঠা আজও অক্ষুণ্ণ।
বৈঁচির বিএল স্কুলের দুর্গা পুজো এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী পুজোর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। জমিদার ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় আজ থেকে প্রায় ১৮৬ বছর আগে গ্রামে দুর্গা পুজোর প্রবর্তন করেন। নিঃসন্তান হওয়ার কারণে ঠাকুরদাসের ছেলে বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরামর্শে নিজের সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য দান করে যান। তাঁর মৃত্যুর পরেও বৈঁচির বিএল স্কুলে দুর্গা পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো এবং দোল উৎসব হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও, পুজোর এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হয়েছে একান্ত ভক্তির সাথে।
বিএল স্কুলের দুর্গা পুজোর বিশেষত্ব এর একচালা প্রতিমা। এই প্রতিমায় দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, সিংহ এবং মহিষাসুর একসঙ্গে থাকেন। বাংলার প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই মূর্তির চোখ টানা এবং মুখের আদল বাংলার নিজস্ব শৈলী অনুযায়ী তৈরি করা হয়। মহিষাসুরের গায়ের রং এখানে সবুজ, যা সচরাচর আজকাল চোখে পড়েনা। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত বৈদিক মতে পুজোর আয়োজন করা হয়। একসময় এই পুজোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করতেন, বিশেষ করে অষ্টমী ও নবমীর অঞ্জলিতে গ্রামের লোকেরা ভিড় করত। তবে আজকাল বারোয়ারি পুজোর সংখ্যা বাড়ায় এই জমিদার বাড়ির পুজোর প্রচলিত ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে গেছে।
পুজোর আড়ম্বর এখন অনেকটাই কমে গেছে। আগে জমিদারের ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পুজোর জন্য অর্থ অনুদান দেওয়া হত, কিন্তু বর্তমানে সেই অর্থের যোগান তেমন আসে না। গ্রামের মানুষ এবং স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের সহায়তায় এই পুজো টিকে আছে। গ্রামবাসী তথা এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা বলছেন, “ভারতবর্ষের কোনো স্কুলে দুর্গা পুজো হয় কি না জানা নেই, তবে বিএল স্কুলে এখনও পুজো হয়। ছোটবেলা থেকেই এই পুজো দেখে আসছি, তবে আগের ঐতিহ্য এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সরকারি সহায়তা না থাকায় দুর্গা মন্দিরের অবস্থাও শোচনীয়। তবে সেসবের পরেও নিষ্ঠা এবং আবেগের সঙ্গে পুজো চলছে, যা বাংলার প্রাচীন জমিদারি পুজোগুলোর ইতিহাসের এক স্মারক হিসেবে আজও টিকে আছে।”
Discussion about this post