কলকাতা বিচিত্র বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে দশকের পর দশক। মানুষের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটেছে ধীরে ধীরে। তাই মানুষের পালকি থেকে বিদ্যুৎ চালিত শকটে পৌঁছাতে দেরী হয়নি। কলকাতা নগরের গোড়াপত্তনের আগে থেকেই এখানে সুতানুটি, গোবিন্দপুর গ্রামগুলি ছিল। তাই সেখানে পালকিও ছিল। তাই নির্দিষ্ট করা বলা মুশকিল কবে পালকির প্রচলন হয়? শুধু বলা যায় কলকাতায় আঠারো শতকের সময়ে পালকির ব্যবহার বেড়ে যায়। এমন কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবেরাও এখানে পালকিতে যাতায়াত করতেন।
পালকির বাহক বেহারাদের মাসহারা ছিল চার থেকে পাঁচ টাকা! পালকি পাঁচ ছয় জন বেহারা বহন করতেন। যাদের নিজেস্ব আর্থিক সঙ্গতি ছিল তাদের নিজস্ব খরচে ২৫ টাকায় পালকির ব্যবস্থা করত। এখনকার দিনে ২৫ টাকায় গাড়ি ভাবলেই মজা লাগে। ভাড়া পালকি আর নিজস্ব পালকির কিছু পার্থক্য থাকত। কলকাতার বুকে মানুষ এপার থেকে ওপারে যেত চেয়ার টাইপের বসানো খোলা পালকিতে। যাক তাঞ্জম বলা হত। বিলাস বহুল জমিদার রাজা রাণীর পালকিতে সোনা রূপা দিয়ে কাজ করাও হত। স্টুয়ার্ট নামে এক সাহেব তাঞ্জোরের রাজ কুমারদের জন্য যে পালকি বানিয়েছিলেন তার দামই ছিল প্রাক ১০০০০ টাকা। সেটিতে আরাম করে বসার বালি , ভেলভেট দেওয়া পর্দা ইত্যাদি ছিল। এই পালকিকে বলে মিয়ানা। এর পর ১৮৯০ সালে কলকাতায় পালকির সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়শো মতো। আর বেহারা প্রায় হাজার দেড়েক। সেই সময় আবার ঘোড়ায় টানা গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছিল।
১৮২৭ সালে বেহারারা ধর্মঘট করে তাদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য। উড়িয়া বেহারারা জনসাধারণের ওপর জোর জুলুম করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করত। তাই জনসাধারণ সরকারের কাছে অভিযোগ জানায়। সরকার আইন করে তাদের নির্দিষ্ট রেট বেঁধে দেন। কিন্তু তারা মানে না। ধর্মঘট চলতে থাকে। তখন ব্রাউন সাহেব দেখলেন এই ধর্মধটের জেরে কাজেকর্মে বেরোন সমস্যাদায়ক হয়ে পড়েছে। তখন তিনি ১৮২৭ সালেই পালকির দুইপাশে চাকা লাগিয়ে চালানোর ব্যবস্থা করলেন। যাকে বলা হত ব্রাউনবেরি। তারপর শহরে এমন ধরনের গাড়ি যা ছ্যাকরা গাড়ি নামে পরিচিত তা চলতে শুরু করল। জনমানসে তখন ঘোড়ার গাড়ি, ছ্যাকরার গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। ধীরে ধীরে কলকাতার বুকে পালকির অবলুপ্তির পথ প্রশস্ত হল।
Discussion about this post