১৫ বছর বয়সে স্কুলের একফালি মাঠের বাইরে প্রথম বড় মাঠে ফুটবলের ছোঁয়া পেয়েছিলেন তিনি। ভারত তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বিহারের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে নেমেছিলেন তখন। ঠিক সেই সময় থেকেই ‘ফরোয়ার্ড’ পজিশনে খেলছেন। জলপাইগুঁড়ির ব্রিটিশ রেজিমেন্টে বেড়ে ওঠা তাঁর। একটা সময় শাসন করেছেন ভারতীয় ফুটবল জগৎ। তাঁর ‘ভোকাল টনিক’ উঠতি ফুটবলারদের জীবনও গড়ে দিয়েছিল। ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র তিনি, পদ্মশ্রী প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বা পি কে ব্যানার্জী।
খেলোয়াড় জীবনের থেকে পিকের কোচিং জীবন নিয়েই আলোচনা হয় বেশি। কিন্তু তাঁর কোচ জীবনের থেকে খেলোয়াড় পিকের জীবন আরও বেশি বর্ণময়। আরিয়ান ও পরে ইস্টার্ন রেলওয়ের মাধ্যমে তাঁর ক্লাব ফুটবলের যাত্রা শুরু। ১৯৫৪ সালে এরিয়ান ক্লাবে যোগ দেন তিনি। কলকাতা মাঠে তাঁর অভিষেক ঘটে তখন থেকেই। ১৯৫৫ সালে চাকরি সূত্রে ইস্টার্ন রেলে যোগ দান তিনি। তারপর বহু ক্লাব ঘুরে ফিরে এসে ফুটবল জীবনের শেষ সময় টুকু আবার ইস্টার্ন রেল ক্লাবেই কাটিয়েছিলেন। ১৯৫৫ তে ইস্টার্ন রেলে খেলার সময়ই জাতীয় দলে ডাক পান পিকে। ১৯ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে তাঁর। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। এই অলিম্পিকে ভারতীয় দল চতুর্থ স্থানে শেষ করে। কিন্তু নিজের অভিষেকেই এক সাড়া জাগানো ফুটবল খেলে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন পি কে। এরপর তিনি ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিকে দেশের অধিনাকত্ব করেন। সেই অলিম্পিকে ফ্রান্সের মতো দলের সঙ্গে গোলও করেন। এরপর ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ এই তিনটে এশিয়ান গেমসে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেন পিকে। তিনি ১৯৬২’র এশিয়ানের সোনাজয়ী ভারতীয় দলে তিনি অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন। সেই ফাইনালে দুটি গোলের মধ্যে একটি গোল ছিল তাঁর। তিনি দেশের হয়ে ১৯৫৬ , ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ তে মারদেকা এবং ১৯৫৯ ও ১৯৬২ তে এশিয়া কাপেও খেলেছেন। দেশের হয়ে মোট ৮৬ টি ম্যাচ খেলে ৬৫ টি গোল ছিল তাঁর। খেলোয়ার হিসাবে ১৯৫৬ সালে মোহনবাগানের বিদেশ সফরের সময় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন পিকে।
কোচ হিসাবে পিকের জনপ্রিয়তার সম্পর্কে বলাই বোধহয় বাহুল্য। ১৯৭০ সাল নাগাদ পিকে জাপান থেকে কোচিংয়ের ট্রেনিং নিয়ে ফেরেন। নিজের কোচিং জীবনে বহু বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছিলেন তিনি। সত্তরের দশকে কলকাতা ময়দান ছিল পিকেময়। তাঁর ভোকাল টনিক মাতিয়ে রাখত কলকাতার দুই প্রধান ক্লাবের খেলোয়াড় তথা সমর্থকদেরও। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান বড় দুই ক্লাবেই কোচিং করিয়েছেন তিনি। একই মরসুমে মোহনবাগানকে জিতিয়েছিলেন তিনটে মেজর কাপ- আইএফএ শিল্ড, রোভার্স কাপ, ডুরান্ড। তাঁরই কোচিংয়ে ১৯৭০- ৭৫ সাল ইস্টবেঙ্গল ও ১৯৭৬ – ৭৯ সালের মোহনবাগান ট্রফির জোয়ারে ভেসেছিল। ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তাঁরই ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত কোচিংয়ে। নিজের খেলোয়াড় তথা কোচিং জীবনে বহু স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছিলেন পিকে ব্যানার্জী। ২০০৪ সালে ফিফার তরফ থেকে সেন্টেনিয়াল অর্ডার অফ মেরিট পান তিনি। ২০০৫ সালে ফিফা শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ফুটবলার হিসাবে ঘোষণা করে তাঁকে। প্রথমদিকের ‘অর্জুন পুরস্কার’ প্রাপকদের মধ্যেও ছিল পিকে ব্যানার্জীর নাম। পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত হন তিনি। পিকে ব্যানার্জি সম্ভবতঃ একজনই যিনি জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব থেকে অলিম্পিকের প্রতিনিধিত্ব, এশিয়ান গেমসে সোনা থেকে পদ্মশ্রী বা অর্জুন পুরস্কার, এত সাফল্য একসঙ্গে উপভোগ করেছেন। প্রায় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অসুখে ভুগছিলেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে বুকে সংক্রমণের জন্য হাসপাতালেও ভর্তি হন। সেই হাসপাতালেই ৮৩ বছর বয়সে এসে জীবনদীপ নিভল এককালের মাঠ উজ্জ্বল করে জ্বলা ‘প্রদীপ’, ‘পি কে’ বন্দ্যোপাধ্যায়।
Discussion about this post