মানুষের জীবনে চলচ্চিত্রের স্থান সেই ষাটের দশক থেকে। সেই ষাটের দশক থেকেই নানান ভাবে চলচ্চিত্র মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। কখনো কখনো আমরা হয়তো আমাদের না পাওয়া ইচ্ছেগুলো এই চরিত্রদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে দেখি। হয়তো তাই এটি আমাদের মনের এতটা কাছের। সেইরকমই ‘ওশিন’ নামক একটি জাপানি ধারাবাহিক ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে জাপানে সম্প্রচারিত হয়।
একটি ছোট্ট জাপানি মেয়ে কীভাবে জীবনের সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সফল হয়েছিল সেই গল্পের ভিত্তিতেই তৈরি এই ওশিন চরিত্রটি। এটা দেশের সর্বকালের সর্বাধিক দেখা টিভি শোগুলির মধ্যে একটি যা জাপানের গন্ডি পেরিয়ে অন্যান্য ৬০ টি দেশে সসম্প্রচারিত হয়েছিল। এটি সুগাকো হাশিদার লেখা শো যা একঘেয়ে প্লট থেকে বেরিয়ে নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল টেলিভিশন জগতে, পুরো পৃথিবীর মানুষ যাকে ভালোবেসেছিল – এটি ছিল একটি এশিয়ান গ্লোবাল ব্লকবাস্টার। ১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে জাপানের গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যে বেড়ে ওঠা এক ছোট্ট মেয়ে ওশিন।যে অসংখ্য ব্যক্তিগত বাঁধা বিপত্তি সহ্য করার পরেও জীবনে সফল হয় ও শেষ পর্যন্ত একটি সুপারমার্কেট চেইনের একজন সফল মালিক হয়ে ওঠে। সিরিজটির এই লেখিকা সুগাকো হাশিদা, এই এপ্রিলে ৯৫ বছর বয়সে লিম্ফোমায় মারা যাওয়ার পর দর্শকদের মধ্যে এই সিরিজটি নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখা দেয়।
বিশ্বের সর্বত্র ওশিন ভক্তরা সোসাল মিডিয়ায় এই শোটির জন্য অভিনব শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। তাইওয়ানে, মিসেস হাশিদার মৃত্যুর সংবাদ ব্রেকিং নিউজ হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল, চীন টাইমস পত্রিকা তাকে “জাতীয় রত্ন” হিসাবে বর্ণনা করেছে। ওশিন ১৯৮৩ সালের একটি আদর্শ আসাদোরা বা “সকালের নাটক” হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল – একটি মহিলা নেতৃত্বাধীন পারিবারিক নাটক বা সিরিজ হিসাবে, যা প্রধানত গৃহবধূদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এল পাসোর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ অরবিন্দ সিংহল বিবিসিকে বলেছেন, “প্রেম, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমা” এর সর্বজনীন মূল্যবোধের জন্য এটি একটি সফল বিশ্ব টিভি শোয়ে পরিণত হয়েছে। ওশিন শত কষ্টের মাঝে তাঁর শক্তি এবং দৃঢ়তার কারণে এত মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।” মিস ওয়াং নামে এক হংকং ভক্ত ৭০ এর দশকে বিবিসি কে বলেছিলেন “ওশিন আমাদের শিখিয়েছিল যে জীবন যতই কষ্টকর হোক না কেন, আপনি যদি সাহসী হন সেটি এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে সহায়তা করতে পারে। “ এই চরিত্রটির বেশিরভাগ অংশই হাশিদার দক্ষ লেখার যাদুর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। শ্রমজীবী মহিলা হিসাবে ওশিনের গল্পের চারিত্রটিও ছিল হাশিদার নিজস্ব জীবনযাত্রার প্রতিধ্বনি।
২০১২ সালে তিনি নিক্কি শিম্বুন সংবাদপত্রে তিনি বলেছিলেন, “জাপানের সমস্ত মহিলা যারা বছরের পর বছর কষ্টে বেঁচে ছিলেন ওশিন হল তাদের রোলমডেল।“ ভিয়েতনাম থেকে পেরু পর্যন্ত, ১৯৮০ র দশকে এই শোটির যে বিশ্বব্যাপী আবেগ জড়িত মোহ দেখা গিয়েছিল তার একটি নাম ছিল: “ও সিনড্রোম” বা “ওশিন্দ্রোম”। “ওশিন, শ্রোতাদের আবেগকে এমন মাত্রায় আলোড়িত করেছিল যে এর আগে অন্য কোনও টেলিভিশন সিরিজ করেনি। বিশ্বব্যাপী এক ধরণের ওশিন জ্বর ছড়িয়ে পড়েছিল।” ডাঃ সিংহল বলেছেন,এই শোয়ের প্রভাব গভীর ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে ওশিনের প্রভাব পড়ে ভয়ংকর ভাবে। ইরানিরা ওশিনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক বাজারের নাম রাখেন “তনাকুড়া” বাজার। এখন এই পোশাকগুলি কেবল তনাকুড়া পোশাক নামে পরিচিত। হ্যানয় অঞ্চলে এমন একটি পাড়া আছে যেখানে ক্লিনার এবং ন্যানি বাস করে তারা “ওশিন কমিউন” নামে পরিচিত। ঘানাতে,”ওশিন” সত্যিকারের কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া মানুষদের বর্ণনা দেওয়ার পক্ষে একটি সাধারণ চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ওশিনের প্রিমিয়ার হওয়ার প্রায় চার দশক পরও, হংকংয়ের মিস ওয়াংয়ের মতো ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে অনুপ্রেরণার এই গল্পটি অবদান অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন,”আমি মনে করি আজকাল লোকেরা, বিশেষত তরুণদের ওশিনের কাছ থেকে শেখা উচিত। আপনার সমস্যার মুখোমুখি হোন না কেন- এমন কিছুই নেই যা সমাধান করা যায় না।” একটি টিভি চরিত্র কিভাবে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে তা দেখিয়েছিল ‘ওশিন’। ‘ওশিন’ টিভি পর্দা থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠেছিল মানুষের ঘরের সদস্য। ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল মানুষের জীবনে। এরকম চলচিত্র আরও তৈরি হোক দিকে দিকে। মানুষের জীবনে পড়ুক চলচিত্রের ইতিবাচক প্রভাব। চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পাক। তবেই তো হবে এক একটা মাস্টারপিস।
Discussion about this post