অন্য রকম! মানে ঠিক কী রকম বলুন তো? আচ্ছা, একটা গল্প বলি। একটি মেয়ে, ধরুন ওই চিনাদের মতো দেখতে। নাক চ্যাপ্টা, হাসলে মাড়ি শুদ্ধ কোদালের মতো দাঁত বেরিয়ে আসে। তার ওপর রোগা, গায়ের রঙ শ্যামলা। ছোট থেকেই চিঙ্কি, তারকা রাক্ষসী, নাক চেপ্টি ইত্যাদি বিশেষণ শুনে বড় হওয়া। ক্লাস সিক্সেই হল এক অপারেশন, যার পরিণামে পেটে আত্মপ্রকাশ করল এক গভীর দাগ। কিন্তু সেই দাগ যত না ক্ষত তৈরি করল, তার থেকেও সমাজের সৌজন্যে ক্ষত-বিক্ষত হল মন। চরম সহানুভূতির সঙ্গে ভয়ঙ্কর বডি-শেমিংয়ের অসাধারণ যুগলবন্দী যেন রোজ খুন করত এক অসহায় মনকে। এরপর হঠাৎ একদিন পাগলা দাশুর চরিত্রের সঙ্গে আলাপ হল সেই মেয়েটির। তারপর জীবনের শিক্ষায় বলিয়ান হয়ে সেই মেয়ে সমাজের ‘তথাকথিত দ্বিচারিতা’কে ছুঁড়ে ফেলল আস্তাকুঁড়ে। এবার তাহলে মেয়েটি নিশ্চয়ই জিতে গেল, ব্যাস, গল্প শেষ! আজ্ঞে না, সিনেমার রূপকথা নয় যে, এটা ঘোর বাস্তব। সবে তো হল শুরু, ধ্যেইতা নাচো গুরু!
মেয়েটির নামটা এবার বলেই দেওয়াই যাক। পৌলমী হালদার ঘোষ। নাম শুনে কী আঁচ করলেন জানি না। তবে মায়ের পদবীকেও নিজের নামে জুড়েছেন পৌলমী। তাঁর দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন ছিল মডেলিং করার, নিউজ অ্যাংকর হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। কিন্তু ওই যে, সমাজের ভাষায়, “দেখতে খারাপ।” তাই কাঁচি করে খুব সুন্দরভাবে বাদ পড়তে থাকলেন নিজের স্বপ্নের জায়গাগুলি থেকে। কাজেই এবার তিনি নিজেই নিজেকে সুযোগ দিলেন জীবন যুদ্ধে। আর তাই বেঙ্গালুরুতে পাওয়া চাকরি ছেড়ে তিনি বানিয়েই ফেললেন এক স্বপ্নের কারখানা, যার নাম রাখা হল ‘অন্য রকম’। স্বপ্ন দেখার সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে পেলেন অরিন্দম দে’কে। দু’জনের জমানো টাকায় কেনা হল কাঁচা মাল। যাত্রা শুরু করল হ্যান্ড পেন্টেড বুটিকটি। কাদি কটনের কুর্তি-পাঞ্জাবি, তাঁর ওপর ফেব্রিকের কাজ ফুটে উঠতে লাগল।
‘অন্য রকম’-এর তরফে পৌলমী জানালেন, “আমাদের বুটিকের সবই হাতে আঁকা এবং হাতে বানানো সামগ্রী, মেশিনে কিছুই করা নয়। বাংলার ছাত্রী, তাই সম্বল ছিল বাংলা কবিতার লাইন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্রদের ছবি থেকে শুরু করে যামিমী রায়ের অনুপ্রেরণা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।” শাড়ি, পাঞ্জাবী, কুর্তি, টি-শার্টের পাশাপাশি হাল আমলের ফ্যাশন-দুরস্ত পোশাকও পাওয়া যাচ্ছে এই বুটিকে। এছাড়াও রয়েছে হাতে বানানো ডায়েরি, নোটবুক, বুক মার্ক, ল্যাম্প। জানা গেল ‘অন্য রকম’ বুটিকের লক্ষ্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা স্বল্প বাজেটেও যেন তাদের পোশাক নিতে পারেন। পৌলমী আরও বললেন, “যেখানে সব ধারা ভেঙে যায় সেখানেই তো আসে আত্মবিশ্বাসের গল্প। সমাজের সমস্ত বুলিং, বডি শেমিং আর সহানুভূতিকে তুড়ি মেরে পোশাক উপস্থাপনের জন্য নিজেই মডেল হয়েছি। পেটের সেই কাটা দাগ দেখিয়েই এবং তাড়কা রাক্ষসীর মতো হেসেই শাড়ি ট্রিপ করি। যারা একদিন কুৎসিত বলে অচ্ছুতের মত আমাকে গন্য করেছিল, আজ তারাই ‘অন্য রকম’ থেকে জিনিস কেনে। এই খারাপ পরিস্থিতিতে চেষ্টা করছি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। তাই ১-১০ অক্টোবর কেউ কিছু কিনলেই তাকে উপহার দেব আমরা। পরবর্তীকালে ইচ্ছে রয়েছে, অজানা গ্রামের অজানা শিল্পী; যাদের শিল্পের দাম কেউ দেয় না। তাদের শিল্পকে মানুষের নজরে নিয়ে আসব। হয়তো যারা কুৎসিত শুনে বড় হয়েছে তারাই একদিন মডেল হবে ‘অন্য রকম’ বুটিকে। এগুলোই স্বপ্ন। হয়তো একদিন সত্যি হবে স্বপ্ন।
Discussion about this post