উমা ফিরেছেন কৈলাসে। বাঙালি হৃদয় এখনো খানিক ভারাক্রান্ত। তবে শূন্য মন্ডপে বিষণ্ণতার রেশ কাটিয়ে আলপনায় সুসজ্জিত গৃহকোণ জানান দেয় মা লক্ষ্মীর আগমন বার্তা। দেবীর আরাধনায় ঘর থেকে উলু-শাঁখের আওয়াজের সাথে ভেসে আসে পাঁচালীর সুর- “দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ। ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস..”
সুজলা-সুফলা বাংলায় আশ্বিনের কোজাগরী পূর্ণিমায় এক কালে লক্ষ্মী আরাধনার সূচনা হয়েছিল মূলত কৃষক পরিবারগুলিতে। মা লক্ষ্মী স্বয়ং ধনসম্পদের দেবী। লোক কথা বলছে, দেবী এদিন প্রত্যেকের বাড়ি যান এবং ডেকে বলেন, “কঃ (কে) জাগর (জেগে)” অর্থাৎ “কে জেগে রয়েছে?” তবে আজ গ্রাম-শহরাঞ্চল নির্বিশেষে বাংলার প্রায় প্রত্যেক হিন্দু ঘরেই তিনি আরাধ্যা। কোথাও মৃন্ময়ী মূর্তি রূপে কোথাও বা সপ্ততরী আবার কোথাও লক্ষ্মী সরায় অঙ্কিত অবয়বে। বর্তমানে অধিকাংশ গৃহে মৃন্ময়ী প্রতিমার দেখা মিললেও এক সময়ে অব্রাহ্মণ গৃহে পটচিত্র অঙ্কিত লক্ষ্মী সরাই ছিল বহুল প্রচলিত। মৃত্তিকা নির্মিত প্রতিটি সরা রৌদ্রে তপ্ত করার পর সেখানে তুলির আঁচড়ে প্রকাশিত হয় পটুয়ার শিল্পী সত্ত্বা। কোনো কোনো সরার উঁচু কানা, কোথাও আবার সেটিকে রাখা হয় সমতলই। খড়ি মাটির আস্তরণের উপর এবার পটুয়ার লাল-নীল-হলুদ রঙ প্রলেপের অপেক্ষা। সেখানে কোথাও দেবী হাজির বাহন পেঁচার সাথে তো আবার কোথাও তাঁদের সঙ্গে দুই সখী জয়া-বিজয়ার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। নানারকম রঙিন নকশাও কাটা থাকত সেখানে।
এই লক্ষ্মী সরার কিন্তু প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল অধুনা বাংলাদেশে। ঢাকায় সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল যে সরা সেখানে লক্ষ্মী-নারায়ণ ধানের শীষ হাতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পাঁচালীর সেই পঙক্তিকেই তুলে ধরা হয়েছে মূলত এখানে – “বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষী নারায়ণ। করিতেছে কত কথা সুখে আলাপন..।” এই সরা ঢাকাই সরা নামেই প্রচলিত। গনকী সরার ন্যায় এখানে আলাদা কোনো প্রকোষ্ঠ থাকেনা। ঢাকাই সরার কানা সামান্য উঁচু থাকে। সাদা রঙের উপর নানা রঙের কারুকার্যে ফুটে ওঠে লক্ষ্মী নারায়ণ সহ বাহন পেঁচা। লক্ষ্মী নারায়ণের দুই পাশে খিলান ন্যায় অবস্থান করছে কদম গাছ। অঙ্কিত রত্নাধারে অলঙ্কার জানান দেয় ইনিই স্বয়ং ধন সম্পদের দেবী। ঢাকাই সরা ছাড়াও প্রচলিত ছিল ফরিদপুরী, সুরেশ্বরী, গনকী প্রমুখ সরা। কাঁটাতারে বঙ্গ বিভাজন হলে বহু শিল্পীই চলে আসেন এপারে। এপার বাংলাতেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায় ঢাকাই সরা। তবে দেবী আরাধনা ছাড়াও এই সরা ঢুকেছে সাধারণের গৃহকোণে। শৌখিনতার পরিচয় হিসেবে নানান রূপে সেই সরাকে মানুষ স্থান দিয়েছে তার ঘরে। আর এখানেই শিল্পীসত্তা-ধর্ম-ঐতিহ্য একত্রে বহন করছে বাঙালির নান্দনিকতা আর সৃজনশীলতাকে। লোকশিল্প হিসেবে আজও বেঁচে আছে এই সরা। ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই না হয় বেঁচে থাকুক এই শিল্প!
Discussion about this post