দেশভাগের পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশের ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা’র ভৈরব নদের তীরবর্তী কার্পাসডাঙ্গার সরকার পরিবার ছিল জ্ঞান-গরিমায় বেশ সম্ভ্রান্ত। এ পরিবারের সন্তান শ্রী মহিম সরকার চাকরির সুবাদে থাকতেন কলকাতায়। কলকতা আমহার্স্ট স্ট্রিটে তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন। মহিম সরকারের সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের খুবই সখ্য ছিল। তার বাড়িতে কবির আসা-যাওয়া ছিল আপনজনের মতো। তার দুই মেয়ে আভা রাণী সরকার ও শিউলী রাণী সরকার নজরুলগীতি চর্চা করতেন। তাদের গানের তালিম দিতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজে। পরবর্তীতে আভা রাণী সরকারের গানের রেকর্ডও বের হয়। প্রখ্যাত লেখক ড. আশরাফ সিদ্দিকী অনুসন্ধান করে নজরুলের কথা ও সুরে আভা রাণী সরকারের ছয়টি গানের রেকর্ড-তথ্য পান।
একাধিক তথ্যসূত্রে জানা যায়, মহিম সরকারের পারিবারিক আমন্ত্রণে একাধিকবার কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় এসেছেন। তবে ১৯২৬ সালে ২৭ বছর বয়সে কবি সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসেন। এ সময় প্রায় দুই মাস কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান করেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন শাশুড়ি গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা ও বড় ছেলে বুলবুল। তারা কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে দর্শনায় নেমে ছয় মাইল গরুরগাড়িতে করে কার্পাসডাঙ্গায় আসেন।
কবি কলকাতা এবং কৃষ্ণনগর থেকে কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গার বিপিন সরকার জানিয়েছেন, কবির সঙ্গে বসে তাস খেলেছেন তিনি। পারিবারিক আমন্ত্রণে কবি নজরুলের কার্পাসডাঙ্গায় আগমন ঘটে। যদিও স্বদেশি আন্দোলন বেগবান করার জন্য অনেক নেতা কর্মীর সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেছেন বলে জানা যায়। প্রয়াত দ্বারিকনাথ ওরফে তেরেন বাবুর ভাষ্যমতে, কার্পাসডাঙ্গা মিশন চত্বরে কয়েকটি ঝাউগাছ ছিল। সেই গাছে একদিন একটি বিষধর সাপ দেখতে পান দ্বারিক। সাপটিকে মেরে ফেলেন তিনি। পরে কবি বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। ‘পদ্ম গোখরা’ নাটকের প্লট এখান থেকেই পান বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালে একটি আটচালা ঘরে তার থাকার জায়গা হয়। যে খাটে তিনি ঘুমোতেন, যে আলমারিটা তিনি ব্যবহার করতেন, তা আজও অক্ষত অবস্থায় আছে। কবির গুরুত্ব অনুভব করে তার স্মৃতি লালন করে আসছেন বংশপম্পরায় প্রকৃতি বিশ্বাস। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে মহিম সরকারের আমন্ত্রণে আসার পর এখানকার কংগ্রেস নেতা শিক্ষক হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে ভাব জমে তার। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস ছিলেন বর্তমান ভারতের শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ফলে শিক্ষিত মানুষ হিসাবে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে কবির বেশ খাতির জমে ওঠে। সেই সুবাদে আটচালা ঘরেই কবির থাকার জায়গা হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম যতবার এসেছেন এ ঘরেই থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আটচালা ঘরটি প্রথমত হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের উদ্যোগেই সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের ছেলে বাবু প্রদ্যুত বিশ্বাস বাবার ভূমিকা পালন করে যান। বর্তমানে কবির স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ করে রেখেছেন হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের দৌহিত্র প্রকৃতি বিশ্বাস। ৯০ বছর ধরে বিশ্বাস পরিবার নিজ খরচে খড়ের ঘরটি সংরক্ষণ করে আসছে। কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার পেছনে এ বিশ্বাস পরিবারের অবদান একেবারে খাটো করে দেখা যায় না।
Discussion about this post