সেই কোন কালে নজরুল লিখেছিলেন- “হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই, ভারতের দুই আঁখি তারা,এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।” এই কবিতার থেকেই বোঝা যায় ভারতে বহু কাল ধরেই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় একসঙ্গে মিলে-মিশে রয়েছে। শুধু ভারত কেন, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখিয়েছে এই বাংলাও। এই বাংলাতে বসেই নজরুল রচনা করেছেন শ্যামা-সঙ্গীত। আবার বর্তমানে বাংলার হিন্দু- মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই দীপাবলি থেকে ঈদ উদযাপন করে থাকে। এই সম্প্রীতির আঁচ পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতাতেও। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, বাংলার প্রথম মসজিদ তৈরি হয় ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। আদি সপ্তগ্রামের তৎকালীন শাসনকর্তা জাফর খাঁ গাজী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই মসজিদের প্রধান আকর্ষণ কিন্তু অন্যই! মসজিদের গায়ে খোদাই করা রয়েছে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত শিলালিপি সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও।
হুগলির অন্তর্গত ত্রিবেণী একটি বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। ভাগীরথী-যমুনা-সরস্বতীর মিলনস্থল এই জায়গাটির ভৌগলিক গুরুত্বও অপরিসীম। এছাড়াও সংস্কৃত শিক্ষার মূল কেন্দ্র হিসাবে নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়ার সঙ্গে ত্রিবেণীও বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এই ত্রিবেণীতেই বাংলার প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে জাফর খাঁ গাজী ১২৯৮ থেকে ১৩১৩ দীর্ঘ পনেরো বছর তাঁর শাসন চালান। তিনিই বাংলার বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের আরেক নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপিত করেন ত্রিবেণীর এই মসজিদকে। শাসনকালের সূচনাতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার এই সর্বপ্রাচীন মসজিদ। যা ‘জাফর খাঁ গাজীর মসজিদ’ নামে পরিচিত হয় ওঠে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ১৩১৫ সালে মসজিদের পাশেই গঠিত হয় দরগা।
ঐতিহাসিকের মতে, পুরোনো হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে জাফর খান এই মসজিদ তৈরি করেন। তাই উল্লেখযোগ্যভাবে এই মসজিদ এবং দরগাতেই ধরা পড়েছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক বিরল নিদর্শন। মসজিদের গঙ্গা অভিমুখে অবস্থিত পাঁচিলগুলোতে আজও দেখা যায় বহু হিন্দু দেবদেবীর প্রতিকৃতি অঙ্কন। এছাড়াও পরবর্তীকালে নির্মিত দরগার খিলানেও দেখতে পাওয়া যায় বহু মূর্তি। শুধু তাই নয়, দরগার ভিতরে অবস্থিত সমাধি কক্ষেও বেশ কয়েকটি সংস্কৃত শিলালিপি দেখা গিয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনার আঁকা ও পরিচয় লেখা রয়েছে সেখানে। জাফর খান প্রতিষ্ঠিত এই দরগায় রয়েছে বিষ্ণুমূর্তি, বুদ্ধমূর্তি ও জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি, যা চার ধর্মের মিলনভুমি হিসেবেও উল্লেখ্য। এমন আশ্চর্য সর্ব ধর্ম সম্বনয় নিয়ে কাজ করেছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ঐতিহাসিকও। ‘কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে এ প্রসঙ্গে বলাও হয়েছে- “Curiously enough, it is not at Gaur, but at Tribeni in the Hughli District, that the oldest remains of Muslim buildings have survived. These are the tomb and mosque of Zafar Khan Ghazi. The former is built largely out of the materials taken from a temple of Krishna, which formerly stood on the same spot but now so multilated as to have lost most of its architectural value.”
শুধু মসজিদই নয়, জাফর খান তাঁর নিজের জীবনেও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ঘটিয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই এই শ্লোকটি আওড়াতেন, “যৎতক্ত্যং জননী-গণৈর্ষদপি ন স্পৃষ্টং সুহৃদ্বান্ধবৈ- যস্মিন পান্থ দিগন্ত সন্নিপতিতে তৈ স্মর্য্যতে শ্রীহরি। স্বাষ্কে নস্য তদীদৃশং বপুরহো সংনীয়তে পৌরুষং ত্বং তাবৎ করুণাপরায়ণপরা মাতাসু ভাগীরথী।”
শ্লোকটি বেদব্যাস রচিত গঙ্গাষ্টক স্তোত্র হলেও তার মুখে প্রচার পাওয়ায় সকলে মনে করত এটি তাঁরই লেখা। আসলে এই শ্লোকটি তাঁকে শিখিয়েছিলেন তাঁরই হিন্দু পুত্রবধূ। জাফরের তৃতীয় পুত্র বর খাঁ গাজী বিবাহ করেছিলেন হুগলি নিবাসী এক হিন্দু মহিলাকে। ত্রিবেণীতে অবস্থিত এই দরগায় জাফর খান, তাঁর তৃতীয় পুত্র এবং তাঁর হিন্দু স্ত্রী, হুগলির সেই রাজকন্যার সমাধি এখনও দেখা যায়। জাফর খাঁ-র এই পুত্রবধূ ছিলেন গঙ্গাদেবীর ভক্ত। তাঁর প্রভাবেই জাফর খাঁ গঙ্গার প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়েছিলেন। এমনকি জাফর খাঁ নাকি গঙ্গাদেবীর পূজাও করতেন। তাঁর কাছেই জাফর খাঁ সংস্কৃত শ্লোক বলা আয়ত্ত করেছিলেন। সাতশো বছরেরও আগে হুগলির গঙ্গা তীরবর্তী ত্রিবেণীতে মুসলিম শাসকের হাত ধরে এমনই এক ইতিহাস রচিত হয়েছিল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও সেই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “পাজোয়ায় বন্দিয়া যাবো শুভি খাঁ পীরে। দফর খাঁ গাজীরে বন্দো ত্রিবেণীর ধারে।।” এই বাংলাতেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিবিধের মাঝে মহান মিলনের কথা। নজরুল বলেছিলেন হিন্দু, মুসলিম আসলে ভাই-ভাই। আবার চন্ডীদাসও বলেছিলেন সবার ওপর সত্য মানুষই। কাজেই এ কথা বলা যেতেই পারে যে জাফর খাঁয়ের মতো কিছু মানুষের হাত ধরেই বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন ঐক্যের সেই ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই বহন করে চলেছে এই বাংলা।
কলমে সায়ন মিত্র
চিত্র ঋণ – সুমঙ্গল সাহা, প্রত্যুষ রায় দাশগুপ্ত, double-dolphin.blogspot.com
Discussion about this post