লোকমুখে কথিত আছে, বীরভূমের এই মন্দিরের কালীর বিগ্রহটি নাকি পৌরানিক মগধের রাজা জরাসন্ধর আমলের। মন্দিরটি সম্ভবত বাংলার অন্যতম প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই কালী মন্দিরের কালীকে মগধরাজ জরাসন্ধ গোপনে পুজো করতেন। পরবর্তীকালে কাশির রাজা চৈত সিং-এর হাত হয়ে, মহারাজ নন্দকুমারের কাছে এসে পৌঁছয় এই কালী মূর্তি। কিন্তু মূর্তি নিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হলে তিনি তা লুকিয়ে ফেলেন। পরে কৌশলে নন্দকুমার কালীর বিগ্রহকে নদীপথে নিজের গ্রাম সংলগ্ন একটি স্থানে এনে প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই স্থানটিই হল আকালীপুর। বীরভূমের এই গ্রামের নামটিও হয়েছে বিগ্রহের নাম অনুসারেই।
প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো গুহ্য কালী আকালীর মন্দিরটি। ১৭৭৫ সালে মহারাজ নন্দকুমার মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বীরভূমের নলহাটি শহর থেকে কিছুটা দূরেই মাঠের মধ্যে আকালিপুরের এই গুহ্য কালীর মন্দিরটি অবস্থান করছে। তারাপীঠ মন্দির থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার এবং নলহাটি শহর থেকে এই জায়গার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। নলহাটির ভদ্রপুর গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে এই আকালিপুর গ্রামটি অবস্থিত। ট্রেনে চেপে গেলে আজিমগঞ্জ-নলহাটি শাখার লোহাপুর স্টেশনে নামতে হয়। সেখান থেকে সহজেই যাওয়া যায় আকালিপুর গ্রামে।
লোকমুখে এই গল্প প্রচলিত আছে, যে মন্দির নির্মাণের সময় নাকি মন্দিরের দেওয়াল ফেটে গিয়েছিল। কারণ দেবী স্বপ্নে ভক্তদের দেখা দিয়ে বলেছিলেন, শ্মশানবাসিনী দেবীর মন্দিরের প্রয়োজন হয়না। মানুষের বিশ্বাস, এখনও সেই নির্দেশের প্রমাণ হিসেবেই মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে দুটি ফাটল রয়েছে। ভারতীয় তন্ত্র ও পুরাণে কালীর একাধিক রূপভেদ রয়েছে। তারমধ্যে এই গুহ্যকালী বা আকালী রূপটি অত্যন্ত বীভৎস বলা হয়েছে শাস্ত্রে। এই কালীর আরাধনা একমাত্র করে থাকেন তন্ত্র সাধকরা। গুহ্যকালীর গায়ের রঙ ঘন কালো। লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা, গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কানে শবদেহরূপী অলংকার, কোমরে ছোট কালো কাপড়, কাঁধে সাপ দিয়ে তৈরি পৈতে, মাথায় জটা। গুহ্যকালী নিয়মিত মৃতদেহ ভক্ষণ করেন।
মন্দিরে রোজদিনই দেবীর পুজো হয়। কালীপুজোর দিন বিশেষ কোনও আয়োজন না হলেও দুর্গাপূজার পর গুহ্য কালীর বিশেষ পুজো হয়। আবার প্রতিবছর রটন্তী কালীপুজোর দিনও দেবীর কালো পাথরের মূর্তিটিকে পুজো করা হয়। পুজো দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থীর ভিড় জমে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণী নদীতে স্নান করে দেবী আকালীর পুজো দিলে সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হবে। পুজোর এই দিনগুলিতে পুজোর পাশাপাশি ভক্তদের ভোগও দেওয়া হয়। কালীপুজোর দিন সর্বত্র যখন পুজোপাঠ চলে, তখন বন্ধ থাকে এই মন্দিরের দরজা। কারণ, জাগ্রত দেবী নাকি মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। কালীপুজোর দিনও তার ব্যতিক্রম ঘটে না।
Discussion about this post