রামপুরহাটে তখন গুপী গাইন বাঘা বাইনের শ্যুটিং করছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাঘার চরিত্রে অভিনয় করছেন বন্ধু রবি ঘোষ। চলাচল থিয়েটারে অভিনয়ের সূত্রে রবিবাবুর সাথে সখ্যতা নিমাই ঘোষের। বন্ধুত্বের সুবাদে পৌঁছে গেলেন শ্যুটিং লোকেশনে, সঙ্গী তার নিজের ক্যামেরা। বাঘের সঙ্গে তখন রিহার্সালে ব্যস্ত ছয় ফুট দুই ইঞ্চির সৌম্যকান্তি মানুষটি – সত্যজিৎ রায়। এক মুহুর্ত নষ্ট করলেন না, খচখচ করে তার অ্যানালগ ক্যামেরায় দুটো রিল খরচ করে ফেললেন। ডেভেলপ করে যে ছবিগুলো বের হল তাতে বন্ধুমহলে তখন দারুণ প্রশংসা। বন্ধুদের কথাতেই খানিক সাহস সঞ্চয় করে যোগাযোগ করলেন প্রবাদপ্রতিম আর্ট ডিরেক্টর বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে। বংশী বাবুই ছবিগুলি তুলে দিলেন পরিচালকের হাতে। ক্ষনিকের নিস্তব্ধতা। তারপর গুরু গম্ভীর কণ্ঠে সত্যজিৎ রায় বলে উঠলেন আপনি তো মশাই আমার সব অ্যাঙ্গেল চুরি করে নিয়েছেন, আমি ঠিক এভাবেই ভাবছিলাম। বাকিটা ইতিহাস। সত্যজিৎ বাবু আজীবন তার সমস্ত চলচ্চিত্রের জন্য স্থির চিত্রকার হিসেবে নিযুক্ত করলেন নিমাই ঘোষকে। প্রবাদপ্রতিম নিমাই ঘোষ হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার।
থিয়েটারের শখ ছিল একসময়। অভিনয় করেছেন বেশ খানিক। শোনা যায়, ট্যাক্সিতে একটি অ্যানালগ ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই এই শখের জন্ম যা তাকে পৃথিবীতে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রীর সম্মান দেয়। তবে নিজেকে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের আলোকচিত্রী হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি নিমাইবাবু। যে থিয়েটার দিয়ে তার শিল্প জগতে হাতেখড়ি, সেই থিয়েটার নিয়ে নিমাই ঘোষের ফটোগ্রাফি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার অন্যতম বিখ্যাত একটি আলোকচিত্র থিয়েটারের মঞ্চে তোলা ছবি যেখানে ধোঁয়ার মধ্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার তোলা পুরনো কলকাতার চালচিত্র এখনও নবীন প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়। বিভিন্ন উপজাতিদের নিয়ে তার প্রচুর উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্রের কাজ রয়েছে। শুধু সত্যজিৎ রায়ের ফটোগ্রাফার নয়, তিনি স্বর্ণযুগের সেলেবদের ফটোগ্রাফার বলেও পরিচিত ছিলেন। সত্যজিৎ ছাড়াও ছবি তুলেছেন মৃণাল সেন, উত্তম কুমার, অমিতাভ বচ্চন, শাবানা আজমি, ওম পুরি, ফরিদা জালাল, শর্মিলা ঠাকুর, গিরিজা দেবী, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, স্মিতা পাটিল, অপর্ণা সেনের মতো নক্ষত্রদের। তার আলোকচিত্র শৈলী বর্তমান ডিজিট্যাল যুগের আলোকচিত্রীদেরও হার মানায়। শোনা যায়, তিনি ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতেন না। সাধারণ আলোকেই অদ্ভুত ভাবে ব্যবহার করে মায়াবী সমস্ত ফ্রেম তৈরি করতে জানতেন নিমাইবাবু। বুধবার ৮৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। আবারও বাংলা তথা ভারত হারাল এক শিল্প-নক্ষত্রকে।
চিত্র সৌজন্য – মণিদীপা সিনহা দে এবং দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
Discussion about this post