পৃথিবীর একাধিক আন্দোলন বা বিপ্লবের প্রসঙ্গে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়- সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতবর্ষেও ব্রিটিশ শাসনে জর্জরিত দেশের বিপ্লবের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সেনা-বিদ্রোহ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম লগ্নের সর্বশেষ এই বিদ্রোহের আগুনে-আঁচে পুড়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক বাহিনী। বলা যেতেই পারে, ইংরেজদের মৃতপ্রায় শাসনের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছিল ১৯৪৬’এর সেই নৌ বিদ্রোহ-ই। তবুও আশ্চর্য হলেও সত্যি, ‘৪৬-এর সেই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে আলোচনা হয় খুবই কম। আজ, স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই ধুলোয় ঢাকা অধ্যায়ই আমাদের চর্চার বিষয়।
ভারতের নৌ বিদ্রোহ কোনও রাতারাতি গড়ে ওঠা বিপ্লব একেবারেই নয়। বিপ্লবের আগুন যে শুধুমাত্র ১৯৪৬-এই জ্বলে উঠেছিল তাও কিন্তু নয়। ১৯৪২-৪৬, এই চার বছরে প্রায় ৯ বার ব্রিটিশ বিরোধী সেনা বিদ্রোহের সূচনা ঘটে ভারতের স্থল-জল-বায়ুতে। ‘৪২ সালে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই নৌ বাহিনীতে বিদ্রোহের আগুন লাগে কোচিনে। এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বাঙালি মান কুমার বসু ঠাকুরের হাত ধরে। তবে সেগুলি সঠিক পরিণাম না পেলেও তার ফলশ্রুতিতেই রচিত হয় ‘৪৬-এর বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। ড: সুমিত সরকারের মতে এই বিদ্রোহ- “One of the most truly heroic episodes in our freedom struggle.”
নৌ বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল- ব্রিটিশ সরকারের বর্ণ বৈষম্য নীতি। এই নীতি অনুযায়ী নৌ-বাহিনীর উচ্চপদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন ভারতীয় নাবিকরা। একই সঙ্গে ভারতীয় নাবিকদের প্রতি দুর্ব্যবহার, খারাপ মানের খাবার ও ইংরেজ নাবিকদের তুলনায় স্বল্প বেতন ইত্যাদি সমস্যাও ইন্ধন জুগিয়েছিল এই বিপ্লবে। এছাড়াও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় সৈন্যদের বরখাস্ত করা হলে তীব্র আর্থিক সংকট এবং বেকার সমস্যা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দী সেনানীদের বিচার শুরু হলে অচিরেই ভারতব্যাপী নৌ বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।
তৎকালীন বম্বে শহরের রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি প্রধান সিগন্যালম্যান এম এস খানের নেতৃত্বে, নৌ প্রশিক্ষণ জাহাজ ‘তলোয়ার’য়ে সূচনা ঘটে বিদ্রোহের। প্রাথমিকভাবে অনশন এবং ধর্মঘটের মাধ্যমেই শুরু হয় আন্দোলন এবং ধীরে ধীরে আরও ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে। বম্বে থেকে শুরু হলেও পরবর্তীতে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আঁচ। করাচি ও কলকাতা থেকেও আসে সমর্থন। বিদ্রোহ পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ঘটিত হয় ‘কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি’ও। মোট ৭৮টি জাহাজ, ২০টি তীরবর্তী প্রতিষ্ঠান এবং ২০,০০০ নৌবাহিনীর নাবিক যুক্ত হয় এতে। এছাড়াও নৌ-কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ মানুষ। কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বম্বে ও কলকাতা । বাড়তে থাকে সভা, মিছিল ও হরতালের সংখ্যা। বম্বেতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও বম্বে স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকে সাধারণ ধর্মঘটে যোগ দেন শ্রমিক শ্রেনী এবং দেশের বিভিন্ন শহরে ক্লাস বয়কটও শুরু হয়। আন্দোলন দমাতে পুলিশের গুলিতে দু’শোর বেশি মানুষের প্রাণ যায় এবং আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় হাজারে।
তবে এতকিছুর পরও শেষ রক্ষা হয় হয় না। সর্মথন দূরের কথা বরং তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের সমালোচনায় শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় আন্দোলনকারীর দল। গতি হারায় বিপ্লব। এছাড়াও সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ব্রিটিশ সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করলে বিপ্লবের আগুন হয়ে আসে স্থিমিত। তবে ব্যর্থ হলেও তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের অহংকারকে প্রায় পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল নৌ বিদ্রোহের আগুনে আঁচ। তবে ভারতীয়দের একত্রিত ক্ষমতার কাছেই হার মানতে বাধ্য হয়েছিল ইংরেজদের দল। বহুল চর্চিত না হলেও, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি হিসাবেই চিরকালীন উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকবে ‘৪৬-এর নৌ বিদ্রোহের নাম।
চিত্র ঋণ – The Wire, Heritagetimes.in, Swarajya
Discussion about this post