এক মোবাইল ফোন থেকে অন্য মোবাইল বা কম্পিউটারে যে কোনও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্লু টুথের জুড়ি মেলা ভার। এ এমন এক প্রযুক্তি যা আপনার স্মার্ট ফোন থাকলে তার সাহায্যে যে কোনও সময়, ইচ্ছে মতো যাবতীয় তথ্য সরবরাহ বা যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। কম ক্ষমতা বিশিষ্ট বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সাধারণতঃ ১০ মিটার দূরত্বের মধ্যেই কাজ করতে পারে এই প্রযুক্তি। তবে বিদ্যুৎ কোষের শক্তি বাড়ালে ১০০ মিটার দূরত্ব অবধিও কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে এর। অর্থাৎ ওয়্যারলেস প্রযুক্তির অন্যতম এক সম্পদই বলা চলে এই ব্লু টুথ বা ‘নীল দাঁত’কে। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কি এই প্রযুক্তিটির এরকম অদ্ভুত নাম কেন? এর পিছনেও রয়েছে এক গল্প…
ব্লু টুথ অর্থাৎ নীল দাঁত, এই নামকরণটি দেওয়া হয় এক ভাইকিং রাজা হারাল্ড ব্লাটান্ড গোর্মসনের নামানুসারে। তিনি ছিলেন ডেনমার্কের অন্যতম বিখ্যাত এক রাজা এবং একজন ভাইকিং। তাঁর নামের ‘ব্লাটান্ড’ কথাটির আসল অর্থ নীল দাঁত। কথিত রয়েছে, রাজার একটি দাঁত নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং সেই নষ্ট দাঁতটি ছিল ঘোর নীল বর্ণের! এই জন্য রাজার নতুন নাম হয়ে যায় ‘হারাল্ড ব্লু টুথ’। অবশ্য আরেকটি গল্পও বেশ প্রচলিত৷ রাজা হারাল্ড নাকি ব্লুবেরি খেতে খুবই পছন্দ করতেন। প্রায় সবসময়ই তিনি এই ফলটি খেতেন। তাই রাজার দাঁত হয়ে গিয়েছিল নীল। এই কারণেই রাজাকে ‘ব্লু টুথ’ নামেই বেশি ডাকা হতো। ৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রায় ৩০ বছর ডেনমার্কে রাজত্ব করেন রাজা ব্লু টুথ।
ফিরে আসা যাক সাম্প্রতিক সময়ে। ১৯৯৬ সাল নাগাদ ইন্টেল, এরিকসন, নোকিয়া ও আইবিএম, এই চারটি সংস্থা মিলিত হয়ে একটি বেতার-মাধ্যম প্রযুক্তির সূচনা করে। ঠিক এই সময় প্রত্যেকটি সংস্থাই স্বল্প দৈর্ঘ্যের তারবিহীন প্রযুক্তিটিতে কাজ শুরু করলেও, এর উপযুক্ত কোনও নামই তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এমন অবস্থায় ইন্টেলের জিম কার্ডাক এবং এরিকসনের সেভেন ম্যাটিসন এই দুই ইঞ্জিনিয়ার একদিন একসঙ্গে একটি পানশালায় মদ্য পান করতে যান। ফাঁকে ফাঁকেই চলতে থাকে ইতিহাস বিষয়ক গল্প। সেই সময় ম্যাটিসনের কাছ থেকে রাজা হারাল্ড ব্লুটুথের একটি কাহিনী শোনেন কার্ডাক। এরপরই তিনি সেই ওয়্যারলেস প্রযুক্তিটির নামকরণ করেন- ‘ব্লু টুথ’। এই প্রসঙ্গে একটি লেখায় জিম এও জানান, ডেনমার্কে রাজা হারাল্ড যেমন বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রিত করেছিলেন; নতুন এই প্রযুক্তিটিও অনেকগুলি বিচ্ছিন্ন ডিভাইসের মধ্যে একসঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। এমনকি এর লোগোতেও হদিশ মেলে রাজার। ব্লু টুথের লোগোটি আসলে নর্ডিক ভাষায় লেখা ‘H’ এবং ‘B’ এর মিলিত রূপ, যা আসলে রাজা হেরাল্ডের সম্পূর্ণ নামের আদ্যাক্ষর।
যদিও নামকরণটির ক্ষেত্রে সবকটি সংস্থা কিন্তু শুরুতেই একমত হয়নি। ব্লু টুথের নামটি সবার কাছে তুলে ধরার জন্য পাওয়ার পয়েন্টে একটি প্রেজেন্টেশন বানান জিম। এমনকি এক হাতে একটি মোবাইল ফোন এবং অন্য হাতে একটি ল্যাপটপ যুক্ত রাজা হেরাল্ডের একটি নকল ছবিও তৈরি করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আইবিএমের প্রস্তাবিত ‘PAN (Personal Area Networking)’ নামেই রাখা হয় প্রযুক্তিটির নতুন নাম। যদিও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন জনিত কিছু সমস্যার কারণে কিছুদিন পরই বাতিল হয়ে যায় সেই নামটি। শেষমেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রযুক্তিটির নাম ‘ব্লু টুথ’ই রাখা হয়। আর সেই নামেই এখন সারা বিশ্ব মাতাচ্ছে ব্লু টুথ। তাই বলা যেতেই পারে, বহু যুগ আগের সেই রাজার অস্তিত্ব কিন্তু আজও মুছে যায়নি কোনওভাবেই। মারা গিয়েও তিনি অমর! স্মার্ট ফোনে মুঠো বন্দী হয়ে তাঁর নাম আজও বেঁচে।
Discussion about this post