আজকাল খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেল খুললে চোখে পড়ছে একটাই খবর। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন! আফগানিস্থানে তালিবানদের তাণ্ডবের খবর। তবে এরকম অস্থির পরিস্থিতি আফগানিস্থানে প্রথম নয়। আগেও দেখা গিয়েছে এরকম গায়ে কাঁটা দেওয়া পরিবেশ। তেমনই এক পরিস্থিতিতে কাবুলে ১৯৮৫ সালের ১৯ জুন জন্ম হয় এক শিশুর। যে ছোট থেকেই উপলব্ধি করেছিল যে মেয়েরা বোরখা হিজাব ছাড়া কোথাও বেরোতে পারবেনা। মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া ,খুন ইত্যাদি ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। আর নারীদের অধিকার? সে তো ছিল দিবাস্বপ্নের সমান। এমন এক পরিবেশে নিজের প্রাণ বাঁচাতে তাকে জীবনের প্রথম ভাগ কাটাতে হয়েছিল পুরুষ সেজে। যার কথা বলছি তিনি হলেন আফগান নারী নাদিয়া গুলাম দস্তগীর।
নাদিয়ার জীবনের কথা জানলে মনে হবে যেন সিনেমার পর্দাতে ফুটিয়ে তোলার জন্য লেখা কোন চিত্রনাট্য। আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ যখন চরমে ঠিক সেই সময়ের কথা। ১৯৯৩ সালে তালিবানদের ছোড়া বোমায় ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বাড়ির একাংশ। এই হামলায় তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে প্রাণ যায় নাদিয়ার নিজের ভাইয়েরও। গুরুতর ভাবে জখম হন নাদিয়া নিজেও। তিনি প্রায় ২ বছর ছিলেন হাসপাতালের বিছানায়, যার মধ্যে ৬ মাস কাটিয়েছেন কোমায়। কোমা থেকে ফেরার পর ১৪ বার তার অপারেশন করতে হয়। এই হামলার ফলেই স্থায়ীভাবে তার মুখের গঠনগত পরিবর্তনও ঘটে। এদিকে ১৯৯৬ সালে কাবুল পুরোপুরিভাবে তালিবানদের হতে চলে যায়। আর সেই সঙ্গে বদলে যায় নাদিয়ার জীবনও।
তাঁর মায়ের পরামর্শে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোদস্তুর নারী হয়েও নাদিয়া তার মৃত ভাই জেইমালের পরিচয় নিয়ে পুরুষ বেশ ধারণ করেন। তখন নাদিয়া ছিলেন ১১ বছরের কিশোরী। পুরুষের সাজে একাই বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করলেন তিনি। অন্যান্য পুরুষদের মতো তিনিও মসজিদের গিয়ে পড়তে শুরু করলেন কোরান। পরবর্তীকালে কাবুলের এক মসজিদে কর্মচারী হিসাবে যোগদানও করেন তিনি। এইভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন। ‘পুরুষ ‘ নাদিয়ার উপার্জনেই খাবার উঠত তার পরিবারের মুখে। এই পুরুষের ছদ্মবেশই ১৬ বছর বয়সে তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল স্কুলে ভর্তি হয়ে শিক্ষালাভ করার। তাঁর কথাবার্তা হাঁটাচলা সবেতেই নিজেকে পুরুষ হিসাবে জাহির করার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিলনা নাদিয়ার। এভাবেই কেটে যায় ১০ বছর। কিন্তু সময়ের সাথে কিশোরী থেকে যুবতী হওয়ার এই ছদ্মবেশ ধারণে দেখা দিচ্ছিল সমস্যা।
২০০৬ সালে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। তাদেরই সহায়তায় নাদিয়া পালিয়ে আসেন স্পেনে। আশ্রয় নেন এক শরণার্থী শিবিরে। এতো বছরের আপসের সমাপ্তি ঘটে এখানেই। নাদিয়া প্রকাশ করেন তার আসল সত্ত্বাকে; তার নারী সত্ত্বাকে। কেবল নিজের আসল সত্ত্বাকে প্রকাশ করেই কিন্তু থেমে থাকেননি নাদিয়া। সমাজ শিক্ষায় অর্জন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা তথা তালিবানদের অত্যাচারের কথা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেন মানুষের কাছে। ২০১০ সালে আগ্নিস রটারের সঙ্গে লেখা তার সেই বইয়ের জন্য তিনি প্রুডেনসি বার্ট্রানা পুরস্কারও পান তিনি। বইটির নাম ‘নাদিয়া দেন এল সিক্রেট দেল মিউ টারব্যান্ট’ (দি সিক্রেট অফ মাই টার্বান)। যা তাকে এনে দেয় বিশ্বজনীন খ্যাতি। ২০১৬ সালে শরণার্থী শিবিরে আগতদের শিক্ষাভার নেওয়ার জন্য তৈরি করেন ‘ব্রিজেল অফ পিস’ নামক এক সংস্থা। নাদিয়ার এই জীবন কাহিনী যেন হার মানায় রূপকথার গল্পকে। আশা রাখি তার আগামী দিনের কর্মকাণ্ড অনুপ্রেরণা দেবে আরও অনেক ‘নাদিয়া’কে।
Discussion about this post