রথের আমেজ বয়ে চলেছে হাওয়ার মত। দেখতে দেখতে চলে এলো এ বছরের উল্টো রথ। রথ যেমন উৎসবের ঐতিহ্য তেমনি কিছু রথের চাকা আজও বয়ে নিয়ে চলে ইতিহাস। পুরান বলে যায় অনেক কথা। তেমনই নদিয়ার বীরনগরের ৬০০ বছরের রথ আজও তার সাথে নিয়ে চলে এক অন্যরকম গল্প। রানাঘাট থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে এক সময়ে অবস্থিত ছিল উলা নামক একটি গ্রাম। ডাকাতের আক্রমণ ভয়ের হলেও নতুন কিছু ছিল না। সেখানেই বসত ছিল মুখার্জি পরিবারের। এ পরিবারের সদস্যরাই জাল ফেলে ডাকাত ধরে। সেই থেকেই গ্রামের নাম হয় বীরনগর। ১৮০০ সালের ২৪ অক্টোবরে নামকরণ করা হয়।
আর ঐতিহ্যবাহী এ রথের গল্প আসলে মুখার্জি পরিবারের গল্প। পারিবারিক রথ উৎসব হয়ে উঠেছে সকলের। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণ সেনের আমলে নবদ্বীপ আক্রমণ হলে তিনি তার রাজধানী বর্তমানের ঢাকাতে স্থানান্তরিত করেন। সভাসদদের নিয়ে সেখানেই রাজত্ব স্থাপন করেন। তার সভাসদদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্রীহর্ষ। শ্রীহর্ষের বংশের ষোড়শ পুরুষ চলে আসেন ফুলিয়ায়। আর সেই বংশই হলো বর্তমানের মুখার্জি বংশ। শ্রীহর্ষের ষোড়শ পুরুষ আসার সময়ে তাদের সঙ্গেই নিয়ে আসেন এই রথ।
এ রথের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রথটি নবচূড়া বিশিষ্ট। রথটি সম্পূর্ণ তামা আর পিতল দ্বারা নির্মিত। এটি তৎকালীন বঙ্গ দেশের ধাতুশিল্পের এক অনবদ্য নিদর্শন। এ রথ বর্তমানের ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসে পৌঁছেছে জলপথে বজরার মাধ্যমে। এ বংশের ত্রিশতম বংশধর মহাদেব মুখোপাধ্যায় তার এই জমিদার বংশের যথেষ্ট উন্নতি ঘটান। বহু অর্থ ব্যয় করে জগন্নাথের স্নানযাত্রা সহ রথ উৎসব পালিত হতো মহা সাড়ম্বরে।
তবে এ উৎসব পালনে নিয়ম রীতির আজও অন্যথা হয়নি। ১২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ছাড়াও স্থান পায় ‘শ্রীধর’ নামক নারায়ণ শিলা। তাকে নিয়েই সম্পন্ন হয় স্নানযাত্রা থেকে শুরু করে উল্টোরথযাত্রা পর্যন্ত গোটা উৎসব। এ রথের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত হয়েছে মহাদেব মুখার্জি ট্রাস্ট বোর্ড। এই বোর্ডের প্রতিটি সদস্য আজও সমান ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এ রথ আসলে কেবল উৎসব নয়, এ রথ এক জ্বলন্ত ইতিহাস। এ রথ পারিবারিক ঐতিহ্যের, এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের কার্যক্রমের সাক্ষী।
Discussion about this post