ভক্তি কথাটি এসেছে ‘ভজ’ ধাতু থেকে। কথাটির অর্থ ‘ভজনা’ করা। ভক্তরা ঈশ্বরের কথা বলে থাকেন মূলত চারটি উপায়ে। সেগুলি হল গুণ গান, লীলা গান, ভাব গান ও নাম গান। শ্রীচৈতন্য, গুরু নানক থেকে শুরু করে মীরা, তুলসী দাস, রাম দাস, জয়দেব ইত্যাদি ভক্তিবাদী মহাজনরা ঈশ্বরের বন্দনায় নাম গানের ওপরেই জোর দিয়েছেন বেশি।
নাম কীর্তনই ভক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ এ কথা বলেন অনেক ভক্তবৃন্দ। যখন বহু মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়ে নাম সংকীর্তন করেন, তখন শব্দ এক পবিত্র কম্পন রূপে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। অনেকের মতে গুরু নানকই গণ-নাম সংকীর্তনকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত করেন। শ্রীচৈতন্য এই নাম সংকীর্তনের জোরেই দেশ মাতিয়েছিলেন। ১৭ শতকের প্রথম দিকে শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর পর কালাচাঁদ বিদ্যালঙ্কার বাংলায় কৃষ্ণনাম সংকীর্তন প্রচারের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। বর্তমানে স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকন এই সংকীর্তনকে এক আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়ে চলেছে। ‘সংকীর্তন’ কথাটির অর্থ অনেকে মিলে একসঙ্গে কীর্তন করা। এই সংকীর্তনের কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজন, যার মধ্যে প্রধান হল এর কথা ও সুরে কোনোরকম জটিলতা থাকবে না। সাধারণতঃ কথা মানে ঈশ্বরের নামই হয়, তবে ঈশ্বরের লীলাও এই কথার মধ্যে আসতে পারে। সুর এমন হবে যাতে সাধারণ ভক্তরা সবাই নির্ভয়ে গলা মেলাতে পারে।
সংকীর্তনে বাদ্যযন্ত্রের বিশেষ ভূমিকা থাকে। সাধারণতঃ যে সব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে পারকাসন ইনস্ট্রুমেন্ট, মেমব্রেনোফোন এবং উইণ্ড ইনস্ট্রুমেন্ট প্রায় সবই থাকে। পশ্চিমবঙ্গে প্রথাগতভাবে সংকীর্তনের প্রথম দলে করতাল, দ্বিতীয় দলে ঢোলক ও খোল এবং তৃতীয় দলে শিঙা (শিঙ্গা) ও রামশিঙার দেখা মেলে। কম ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঝুমুর এবং প্রেমজুরি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। খোলের অন্য নাম মৃদঙ্গ। এটি পোড়ামাটির তৈরী বিশেষ গড়নের ড্রাম, যার দুই দিকে চামড়ার পর্দা বা মেমব্রেন থাকে এবং দুই দিকই হাতের আঙুল দিয়ে বাজানো হয়। এর ডানদিকের চামড়া লাগানো অংশটি ছোট (৯-১০ সেন্টিমিটার ব্যাস) এবং বাঁ-দিকেরটি বড় (২০ সেন্টিমিটার ব্যাস)। সাধারণতঃ এই চামড়া হিসেবে ছাগলের চামড়া ব্যবহার করা হয়। অবশ্য আজকাল ফাইবার গ্লাসের খোলের ব্যবহারও দেখা যায়। ইস্কনের সংকীর্তনে চার ধরণের খোল ব্যবহৃত হয় – ফাইবার গ্লাসের, পিতলের, ঈশান দাসের আবিষ্কৃত ‘বলরাম মৃদঙ্গ’ (যা ফাইবার গ্লাসের তৈরী হলেও বেশ ভারী) এবং পোড়ামাটির বডি ও মহিষের চামড়ার মেমব্রেন-যুক্ত খোল।
দোলযাত্রার সঙ্গে নগর সংকীর্তনের যোগটি যে খুবই প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দোলের দিন সকালের দিকে এই নগর সংকীর্তনের চল রয়েছে। দোল বা ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীচৈতন্যের জন্ম হয়েছিল বলে বৈষ্ণবরা ঐ দিনটিকে গৌর পূর্ণিমাও বলেন। ওই দিন নানারকম উৎসবের আয়োজন ও হয়, তার মধ্যে নাম সংকীর্তনও পড়ে।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – কৌলাল
Discussion about this post