দুর্গাপূজা, বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবকে ঘিরেই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ইতিহাস। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। ফলে এই সর্বজনীন পূজার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। তার বহু আগে থেকেই পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা আয়োজিত হতো, প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতে। কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পুজো’ নামে পরিচিত।
এরকমই একটি ঐতিহ্যশালী পূজা হল মুসতৌফিদের দূর্গাপূজা। যার পত্তন হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের শেষলগ্নে, ঔরঙ্গজেবের আমলে। প্রায় তিনশো বছর আগে থেকে হুগলি জেলার শ্রীপুর এবং সুখারিয়ার মুসতৌফি বাড়িতে আয়োজন হচ্ছে শারদীয়া দুর্গা পুজোর। ১৬৫৭ সালে দিল্লির সিংহাসনে তখন ঔরঙ্গজেব। শায়েস্তা খান বাংলার মনসবদার। সেই বছরেই শান্তিপুরের উপাধ্যায় মোহন মিত্র নদিয়ার টেকা গ্রাম থেকে পরিবারসহ চলে আসেন হুগলি নদীর পাশের উলা গ্রামে। মোহন মিত্রের ছেলে রামেশ্বর মিত্র ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। ফলে তাকে সুবা বাংলার কোষাধ্যক্ষর চাকরী দেওয়া হয়।
কয়েকদিনের মধ্যেই রামেশ্বর মিত্র প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর কাজের দক্ষতা দেখে সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিজে তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে ‘মুসতৌফি’ উপাধি দেন। এই মিত্র বাড়ির পুজোই ‘মুসতৌফিদের পুজো’ বলে পরিচিত। মুঘল সম্রাটের তরফ থেকে রামেশ্বরকে স্মারক ও পুরস্কার স্বরূপ সম্রাটের ডান হাতের তালুর ছাপ দেওয়া সোনার পাঞ্জা দেওয়া হয়। এই পাঞ্জাই পরে মিত্র মুসতৌফিদের পারিবারিক প্রতীকে পরিণত হয়।
উপার্জিত অর্থ দিয়ে রামেশ্বর মিত্র নদিয়ার রাজার থেকে জমিদারির এস্টেট কিনে গড়ে তোলেন নিজের জমিদারি। কয়েক বছর পর থেকেই আস্তে আস্তে হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতে শুরু করলে নদী ক্রমশ উলা গ্রাম থেকে দূরে চলে যেতে শুরু করে। ফলে নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্য ও চাষাবাদে মন্দা দেখা দেয়। এরপরেই সেই সাম্রাজ্যের হাল ধরেন রঘুনন্দন মিত্র, রামেশ্বর মিত্রর বড় ছেলে।
রঘুনন্দন মিত্র ছিলেন সেই সময়ের একজন খ্যাতনামা জ্যোতির্বিদ। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার এক জটিল সমস্যায় পড়ে রঘুনন্দনের শরণাপন্ন হন। রঘুনন্দন সেই সমস্যা সমাধান করায় খুশি হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র হুগলি নদীর তীরে তাঁর আঁটি শ্যাওড়া পরগনার নিঃশুল্ক স্বত্ব ‘মহা ত্রাণ’ হিসেবে রঘুনন্দনকে দেন। ১৭০৮ সালে রঘু নন্দন উলা থেকে আঁটি শ্যাওড়ায় চলে আসেন এবং সেটিকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলেন। নাম রাখেন শ্রীপুর।
নিজে ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী। অত বড় জমিদারির মালিক হয়ে নিজে থাকতেন একতলা বাড়িতে। ফলে শ্রীপুরে গেলে সেই বাড়ির কোনও চিহ্নই এখন পাওয়া যাবে না। বরং সেই ঐতিহ্যের কথা জানান দেবে রঘুনন্দনের তৈরী করা তিন শতাব্দী প্রাচীন কাঠের চন্ডী মণ্ডপ। সেই মণ্ডপেই দুর্গা পুজো হয় শাক্ত মতে। রঘুনন্দন ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত। সাধারণত, বাড়িতে গোবিন্দ প্রতিষ্ঠিত থাকলে দূর্গাপূজা হয় বৈষ্ণব মতে, কিন্তু এখানে সে নিয়ম ভিন্ন। প্রতি বছর রাস উৎসবেও মেতে ওঠে গোটা শ্রীপুর।
Discussion about this post