ইতিহাসের পাতা ওল্টালে যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম বেশি চোখে পড়ে, তার মধ্যে বেশিরভাগ জনই প্রায় হিন্দু। আরও সহজ করে বললে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে মানুষ আজও যাঁদের মনে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই প্রায় বেশি৷ অন্য ধর্ম বিশেষ করে মুসলিমের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনাই বলা চলে। তবে অতীতে নজর ফিরিয়ে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে মুসলিমদের তালিকাটা কিন্তু বেশ লম্বাই। পরাধীনতার বছর গুলিতে প্রায় হাজার হাজার মুসলিম বিপ্লবী নিজের আত্ম বলিদান দিয়েছেন এই দেশেরই স্বার্থে। সেই মুছে যাওয়া ইতিহাসের পাতা থেকেই তুলে ধরা হল এমন কিছুজনের কথা যাঁরা না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য দেখতে হয়তো লেগে যেত আরও দীর্ঘ কিছু বছর…
ভারতের কংগ্রেসের ইতিহাসের পাতা ওলটালেই যাঁদের নাম চোখে পড়ে তাঁরা হলেন গান্ধীজি, নেহেরু, নেতাজী সুভাষ বা আরও অনেকেই। কিন্তু অনেকেরই মনে নেই হাকিম আজমল খানের কথা৷ তৎকালীন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এমনকি কংগ্রেসের নেতা হিসাবে জেলও খেটেছেন বহুবার। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক, তবে গরীব মানুষদের থেকে কোনওরকম অর্থ নিতেন না তিনি। নেই মৌলানা আজাদের কথাও। যাঁর সাহায্য ছাড়া গান্ধী বা নেহেরু প্রায় অচল ছিলেন। বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল তাঁর নামও। ‘কমরেড’ এবং ‘হামদর্দ’ নামে দুটি ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মওলানা মহম্মদ আলি এবং শওকত আলি। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে বরাবর জড়িত থাকত তাঁদের নামও।
ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে মাত্র একজন বড়লাটকে হত্যা করতেই সক্ষম হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীর দল। জানেন কি তিনি কার হাতে নিহত হন? মহম্মদ শের আলি৷ শাবল দ্বারা তিনি হত্যা করেন মেয়োকে। এরপরই তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়৷ তবে তাঁর এই কাজ ব্রিটিশ শাসনের ভিত একটু হলেও নড়বড়ে করে তুলেছিল। এরকমই আরেকজন ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভি৷ ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে দেশের মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসের প্রথমেই উঠে আসে তাঁরই নাম। সকল প্রকার ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতেন তিনি। ইংরেজের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ভীত গড়ে তুলতে তাঁর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ছিলেন তাবারক হোসেনও। যাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের ওয়ারেন্ট প্রায় নিত্য ঘটনাই বলা চলে। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা নিশ্চয়ই আজ কারোর অজানা নয়। ঠিক কার গ্রেফতারির প্রতিবাদে ঘটেছিল সেই ঘটনা? তিনি বিপ্লবী সইফুদ্দিন কিচলু। ব্রিটিশদের জেল খাটা আসামী ছিলেন তিনিও। কিন্তু ইতিহাস আজ এঁদেরই ভুলতে বসেছে।
এবার পরিচিত কিছু নামের সঙ্গে যুক্ত কিছু মুসলিম বিপ্লবীর কথাও জানা যাক। নেতাজীর অত্যন্ত কাছের দুই মানুষ ছিলেন, আবিদ হাসান এবং শাহনেওয়াজ খান। যাঁদের ছাড়া এক পাও চলতেন না তিনি। এছাড়াও আজাদ হিন্দ ফৌজে উপস্থিত ছিলেন আরও বহু মুসলিম যোদ্ধা। যাঁদের নামও নেই ইতিহাসের পাতায়। শুধু পুরুষরাই নন, মুসলিম মহিলারাও কোনও অংশেই কম ছিলেন না। শওকত আলি-মহম্মদ আলির মা আবেদি বেগম চিরকাল ব্রিটিশ বিরোধী কাজে ছেলেদের পাশে ছিলেন। নিজে চরকা কেটে খাদিও পরতেন এবং মানুষকে অনুপ্রেরণাও যোগাতেন। মওলানা শফি দাউদির স্ত্রী জুবেইদা দাউদিও ছিলেন বিপ্লবীদের দলে। সক্রিয় ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেছিলেন। এরকম আরও কিছুজন ছিলেন আনসারী বেগম, রাজিয়া খাতুন, খাদিমা বেগম প্রমুখ…
আজ ইতিহাস থেকে মুছে গেছে এঁদের প্রত্যেকের নামই। কেন? তার উত্তর অজানা। হয়তো কিছু ক্ষমতালোভী হিন্দু নেতার চক্রান্তেই মানুষ আজ ভুলে গিয়েছে তাঁদের। তাঁদের সম্পর্কে উদাসীন ঐতিহাসিকগণও। তবে তাঁদের আত্মবলিদানের কথা ভোলা কি এতই সহজ? সাদা-কালো কয়েকটি পাতায় লেখা কিছু নাম বা ঘটনা কি আদৌ কি ধার্য করতে পারে এঁদের প্রাণের দাম? উত্তর একটাই, না। তাই ইতিহাস থেকে মুছে গেলেও ভারতের বুকে আজও লেখা থাকবে এই মুসলিম বিপ্লবীদের নাম। যাঁদের রক্ত জল করা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একসময় স্বাধীন হতে পেরেছিল আমাদের প্রাণের দেশ, ভারতবর্ষ।
Discussion about this post