সাম্প্রতিক কালে যখন ধর্ম ঘিরে মানুষের হানাহানি হাসি কেড়ে নেয় সাধারণের মুখ থেকে তখন অবাক করে দেয় বয়রা কালীর মন্দিরের ইতিহাস। মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠাতা, তাও আবার মুসলিম দারোগা সাহেবের হাতে! এমন গল্প শুনলে হয়তো তেড়ে আসবে ধর্মান্ধরা। কারণ তারা তো ঈশ্বর ভাগেই বিশ্বাসী।
উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ শহর। এখানকার ১০ নং জাতীয় সড়কের ধারে মা বয়রা কালীর মন্দির। শহরের বুকে বয়ে চলেছে শ্রীমতি নদী। হতে পারে বর্তমানে নদী হারিয়েছে তার যৌবন। তবে এককালে এই নদীতে পারাপার হতো বাণিজ্যের বড়ো বড়ো নৌকা। কাহিনীটি সেই সময়েরই। এই নদীপথ দিয়ে যাতায়াত করতেন যেসব বণিকরা তারাই নদীর ধারে এক বয়রা গাছের নীচে মা কালীর পূজো শুরু করেন। সেই থেকেই এখানে মা কালীর নাম বয়রা কালী। তারা প্রতিষ্ঠা করেন দেবীর বেদী। শোনা যায়, জঙ্গলাকীর্ণ সেই জায়গা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ডাকাতদের আস্তানায়। মায়ের পুজো শুরু করে তারাও। ইতিমধ্যে এলাকায় নিযুক্ত হয়েছেন নতুন দারোগা নজমূল হক,সালটা ১৯৩২। তবে নতুন দারোগার আবার অভিনয় চর্চায় বেশ ঝোঁক। মাঝে মাঝেই এলাকার মানুষজনদের নিয়ে নাটক-যাত্রাপালার আসর বসাতেন। উৎসাহ দিতেন মানুষজনকে যাতে এই চর্চা কখনো বন্ধ না করে। এই দারোগা মশাইয়ের স্বপ্নে একদিন হাজির হোন মা বয়রা কালী স্বয়ং! তিনি তাঁকে আদেশ দেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করবার। দারোগা নিজে মুসলিম হলে হবে কি, সব ধর্মের প্রতি তাঁর সমান শ্রদ্ধা।
ঈশ্বরের আবার জাত-ধর্ম কি? তিনি বেরিয়ে পড়েন মন্দির নির্মাণের অর্থ সংগ্রহ করতে। এলাকাবাসীর কাছে যতটুকু সম্ভব চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং বাকি অর্থ তিনি জোগাড় করেন এক লবণ গাড়ির নিলাম থেকে। আয়োজন করলেন পুজোর সমস্ত সামগ্রীর। সেই কাঁচা মন্দির আজ পরিণত হয়েছে পাকা মন্দির বাড়িতে।মন্দিরে আজও মহাড়ম্বরে প্রতি দীপান্বিতা অমাবস্যায় পূজিতা হয়ে আসছেন মা। বিদেশ বিভূুঁই থেকেও হাজির হয় ভক্তগণ। পুজোর দিনে লক্ষাধিক ভিড় সামলাতে মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশ বাহিনী। ১৯৯৮ সালে ভক্তদের চেষ্টায় এবং অর্থে গড়ে তোলা হয় মা বয়রার অষ্টধাতুর মূর্তি। মূর্তিটি নির্মাণ করেন কৃষ্ণনগরের শিল্পী মৃগাঙ্ক পাল। পুজোর দিন মাকে সাজানো হয় সোনার গয়নায়। ভোগে থাকে তিন রকমের সব্জি এবং পাঁচ রকমের মাছ ভাজা। পূজোর দিন রাত্রিবেলায় নাকি মা বের হোন ভক্তদের মাঝে। অনেকেই নিঝুম রাস্তায় শুনেছেন মায়ের নূপুরের শব্দ। মায়ের পূজোয় অংশ নেন এলাকার অন্য ধর্মের লোকেরাও। সরকারি নিয়ম মেনে পুজোয় বন্ধ হয়েছে বলি প্রথা।
নজমূল সাহেবের উদারতা এখনো পথ দেখায় বর্তমান প্রজন্মকে। তাঁর নামে কালিয়াগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নজমূ নাট্য নিকেতন’। তাহলে এখনও রয়েছে আশার আলো! এখনও হয়তো উপর থেকে কেউ মুচকি হেসে বলছে, “ভয় নেই, ওরে ভয় নেই।”
Discussion about this post