আজকের দিনে নাচ শেখার একটা বেশ চল হয়েছে। ছোট্ট থেকেই গুটিগুটি পায়ে নাচের স্কুলে ভর্তি হয় খুদেরা। আবার নাচকেই পেশা করে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন এ যুগের বহু উঠতি ছেলেমেয়েরা। কিন্তু আজ থেকে কয়েক দশক পেছনে হাঁটা দিলেই দেখবেন নাচ যেন ছিল সেযুগের এক অভিশাপ। নাচ জানা মেয়েদের নিয়ে চলত সে কী ভীষণ কাদা ছোড়াছুড়ি। ‘বাজারি’, ‘নষ্ট’ এসব তকমাগুলো তাদের গায়ে লাগিয়ে দিত সমাজ। কিন্তু সেই সময়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়েই নাচকে ভালোবেসেছিলেন মিস শেফালি। অপবাদ কিংবা খারাপ দৃষ্টিগুলোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।

বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা গ্রাম। ছাপোষা এক মধ্যবিত্তের সংসারে জন্ম নিলেন আরতি। ঠিক সে সময়ই বাংলাদেশে চলছে উত্তাল রাজনৈতিক মারদাঙ্গা। সপরিবারে তাঁরা পালিয়ে এলেন এদেশে। কোনোরকমে মাথা গুঁজতে জায়গা পেলেন কলকাতার অহিরিটোলায়। শুরু হল অভাব অনটনে ভরা টনাটানির সংসার। আরতি’র মা সুভাষিণী দেবী বাবুদের বাড়িতে শুরু করলেন পরিচারিকার কাজ। ওদিকে বাবা রামকৃষ্ণ দাস একটি ফলের দোকানে সামান্য হিসাব রক্ষকের কাজটি পেলেন। কিন্তু ওই অল্প ক’টা টাকায় সংসার চালাতে তাঁদের একরকম হিমশিম খাওয়ার জোগাড়। ফলত কিশোরী বয়সেই আরতিকে নামতে হল রোজগারের পথে। মাত্র এগারো বছর বয়সেই কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিলেন আরতি। আর সেখানেই সাহেবি পার্টির নাচের সাথে প্রথম পরিচয় হল কিশোরী আরতির। ভালোবেসে ফেললেন নাচকে। ওই বাড়িরই এক যুবক তাঁকে ক্যাবারে নাচের জগতে আসার পরামর্শও দিলেন। পার্ক স্ট্রিট ফার্পোয় নাচ দেখিয়ে প্রথম তাঁর হাতে উঠল ৭০০ টাকা। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে হোটেলে নাচছে, কলঙ্ক লাগল গায়ে। বাড়ি সমাজ কেউই ভালো ভাবে নেয়নি সেদিন তাঁর এই পেশাটিকে। কিন্তু তাতে কি! নাচ যে তখন আরতির কাছে আবেগ। দূর্দান্ত ক্যাবারে নর্তকী মিস শেফালির আড়ালে তাই ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ল আরতি দাস নামটি। হয়ে উঠলেন কলকাতার ‘কুইন অব ক্যাবারে’। কলকাতা মাতিয়ে রাখার তখন একটাই নাম, মিস শেফালি।

ক্যাবারে ডান্সার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা নাটকেও দেখা গিয়েছে মিস শেফালিকে। ‘চৌরঙ্গী’, ‘রঙ্গিনী’, ‘সম্রাট সুন্দরী’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’—আরও কত। অভিনয় করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের দুটি ছবিতেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’। ২০২০ সালে মিস শেফালি প্রয়াত হন। সে যুগের সমাজ তাঁর নামে জঘন্য কুৎসা রটালেও তাঁর নৃত্যশৈলীর গুণে আজও বাংলার বুকে তিনি এক অতুলনীয় নৃত্যশিল্পী।
সম্পাদনা অনন্যা করণ
Discussion about this post