বাংলার ভূমি সকল ধর্মের মিলনক্ষেত্র। একদিকে যেমন বাংলার প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির, অন্যদিকে বাংলার বুক জুড়ে রয়েছে বহু পীরের মাজার। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে একে অপরের উৎসব আনন্দের সাথে পালন করেন। তবে দুই ধর্মের সম্প্রীতির এক অনন্য নজির গোপালনগরে হজরত সাহেবের মাজার। গ্রামে নেই একটিও মুসলিম পরিবার। হিন্দু গ্রামবাসীরাই দেখাশোনা করেন এই মাজারের। হুগলী জেলার পাণ্ডুয়ার গোপালনগরে সালবেনে পুকুরের উত্তর দিকে অবস্থিত এই মাজার। পীরের নাম হজরত শামসের গাজী। পীর বাবা বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণের শেষে বিশ্রাম নেওয়ার সময় এই স্থানেই দেহ রাখেন। এখানেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়। তারপর কেটে গেছে বহু সময়। বাঁধানো হয়েছে পীর সাহেবের মাজার। সর্বদা সালু কাপরের আবরণ থাকে সমাধির ওপর।
এই মাজারের সাথে জড়িয়ে আছে এক প্রাচীন লোককাহিনী। জানা যায়, এক সময় গ্রামে কলেরা মহামারির আকার ধারন করেছিল। বহু মানুষ প্রাণ হারান এই মহামারির কারণে। সেই সময় পীর বাবার অলৌকিক ক্ষমতাতেই গ্রামবাসীরা এই মহামারি থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তখন থেকেই এই পীর সাহেবের প্রতি গ্রামবাসীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি আরও বেড়ে যায়। এরপর দলে দলে মানুষ নিজেদের সমস্যা নিয়ে ভিড় জমাতে থাকেন পীর সাহেবের কাছে। প্রতি বছর মাঘ মাসে পীর সাহেবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন হিন্দু গ্রামবাসীগণ। এই সময় একজন মুসলিম খাদেম নিকটবর্তী গ্রাম থেকে এই মাজারে আসেন। তার তত্ত্বাবধানেই চলে এই অনুষ্ঠান। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এই উৎসবে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। তবে এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হরিনাম সংকীর্তন। বহু দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে এই সময়। তাদের মতে এই উৎসব সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
বাংলায় সর্ব ধর্মের প্রতি সম্মান ও সম্প্রীতি মূলত লক্ষ্য করা যায় তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী সময়ে। এই পরিবর্তন এসেছিল স্বয়ং শ্রীচৈতন্য দেবের হাত ধরে। সেই সময় হিন্দু সাধকের যেমন মুসলমান শিষ্য ছিল, মুসলমান পীরদেরও বহু হিন্দু শিষ্য ছিল। চৈতন্যেদেবের উদার মানবতাবাদী ধর্মপ্রচারের ফলস্বরুপ বাংলার মাটি হয়ে উঠেছিল এক মহা মিলনের পীঠস্থান। বিভিন্ন মুসলমান পীর, ফকি্ বাউলের আবির্ভাব এই মিলনের পথে যেন সেতু রচনা করেছিল।
তথ্য ও চিত্র ঋণ – অরণ্য
Discussion about this post