ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্দোলনের এক অন্যতম আঁতুড়ঘর ছিল বাংলা। এই বাংলা থেকে কত যে বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তার কোনও হিসাব আজ মেলে না। তবে শুধু পুরুষরাই নন, বাংলার নারীরাও কিন্তু কোনও অংশে কম ছিলেন না। বিপ্লবের আঁচে নিজেদের পুড়িয়ে স্বাধীন ভারত গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাও। এরকমই একজন ছিলেন তিনি। ছিলেন গান্ধীজির একনিষ্ঠ ভক্ত। সক্রিয়ভাবে ‘ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তবে স্বাধীন ভারতের সূর্য দেখার আগেই ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ হারান। তিনি হলেন বাংলার অনন্যা এক নারীশক্তির উদাহরণ, আমাদের সবার পরিচিত ‘গান্ধীবুড়ি’ ওরফে মাতঙ্গিনী হাজরা।
মেদিনীপুরের তমলুকের হোগলা নামক এক গ্রামে ১৮৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মাতঙ্গিনী। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরই বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। তিনি ছিলেন গান্ধীজির মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই সবার কাছে তিনি গান্ধীবুড়ি নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং ১৯২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের এক সক্রিয় সদস্যা ছিলেন মাতঙ্গিনী। এরপর ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। এর ফলে তাঁকে গ্রেপ্তারও করে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী। লবণ আইন ভঙ্গ করার জন্য ৬ মাস কারাদণ্ডও হয় তাঁর। তবে মাতঙ্গিনীকে ইতিহাস অমর করে রেখেছে ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মাধ্যমে। মূলতঃ গান্ধীজির আহ্বানেই ৯ই আগস্ট শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন এবং তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মাতঙ্গিনীও।
আগস্টে শুরু হলেও তমলুকে সে বিপ্লবের জোয়ার এসে লাগে সেপ্টেম্বরে। ২৯ সেপ্টেম্বর মাতঙ্গিনীর নেতৃত্বেই তমলুক দখলের উদ্দেশ্যে শুরু হল শোভাযাত্রা। যার মধ্যমণি স্বয়ং গান্ধীবুড়ি। কাতারে কাতারে মানুষ যোগ দেন সেই শোভাযাত্রায়। থানার কাছাকাছি আসতেই শুরু হল গুলিবর্ষণ। আহত হলেন বেশ কিছু বিপ্লবী। তবু থামলেন না কেউই। তাঁদের মুখে তখন একটাই রব, “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে”। সঙ্গে বন্দেমাতরম ধ্বনি। তাঁরা যত এগোন বাড়তে থাকে গুলি বর্ষণও। সবার আগে ছিলেন মাতঙ্গিনী। তাঁর এক হাতে জাতীয় পতাকা, অন্য হাতে শাঁখ। শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মাতিয়ে তুললেন তিনি। এবার পরপর তিনটি গুলি এসে লাগল তাঁর শরীরে। দুটি দুই হাতে, আরেকটি তাঁর কপালে, প্রাণহীন দেহ তখন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। হাতে তখনও শক্ত করে ধরা ছিল জাতীয় পতাকাটি।
স্বাধীন ভারতের প্রথম সূর্য আর দেখা হয়নি মাতঙ্গিনীর। তবে বাংলার বুকে বিপ্লবের আগুন বেশ ভালো মতই জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি নিজেই ছিলেন জ্বলন্ত এক বারুদ। তাঁর আঁচে পুড়ে ভবিষ্যতে আরও বহু বিপ্লবীই অনুপ্রেরণার পাঠ পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতার শহরের বুকে প্রথম নারী মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। বিদ্যালয় থেকে শুরু বিভিন্ন পাড়া এবং রাস্তাও নামাঙ্কিত হয়েছিল তাঁর নামে। ২০০২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষ্যে মাতঙ্গিনীর ছবি দেওয়া ডাকটিকিটও বের করা হয়েছিল। তবে তাঁর আত্মবলিদানের পর বহু বছর কেটে গেলেও তাঁর নামে নেই কোনও সংগ্রহশালাই। ফলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচিতি একজন সাধারণ বিপ্লবী হিসাবেই। তাঁকে নিয়ে চর্চাও বেশ কমই হয়। মাতঙ্গিনীর জীবন এবং কর্মকান্ডের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য বর্তমানে আলাদা করে সংগ্রহশালার বেশ প্রয়োজন বলেই মনে করেন তমলুকের বাসিন্দারা। সেটি তৈরির কাজও খুব তাড়াতাড়িই শুরু হবে, এমন স্বপ্নেই বিভোর রয়েছেন তাঁরা।
Discussion about this post