আমরা তাঁকে ছোট বেলা থেকেই জানি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবেই। কিন্তু তিনি যে প্রেমেরও কবি। তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ছিল ভালোবাসার ইস্তেহার। কখনও তা পূর্নতা পেয়েছে, কখনও কবি জীবন থেকে উপহার পেয়েছেন এক বুক শূন্যতা। তবে নজরুলের দাম্পত্য জীবনের উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি পর্বেই প্রেম তাঁর স্বাক্ষর রেখেছিল।
১৯২০ সালের শেষের দিকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতেই কুমিল্লার বই ব্যবসায়ী আলি আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। আকবর খানের আহ্বানে নজরুলের কুমিল্লায় প্রথম আসা। সেখানে আলি আকবর খান বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে ৪/৫ দিনের জন্য ওঠেন। ইতিমধ্যে আশালতা সেনগুপ্তের বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের আকস্মিক মৃত্যু হলে আশালতার মা গিরিবালা দেবী ত্রিপুরা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দেওর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কুমিল্লার বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে ওঠেন। এখানেই আশালতার সাথে নজরুলের প্রথম দেখা। সেনগুপ্ত পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহের কারণে এই অল্প সময়ের মধ্যেই পরিবারটির সঙ্গে নজরুলের হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। গান, কবিতা, হৈ-হুল্লোড়ে নজরুল মাতিয়ে রেখেছিলেন সব্বাইকে। সেনগুপ্ত পরিবারও আপন করে নিয়েছিলেন দামাল নজরুলকে। পরবর্তী সময়ে নজরুলের হৃদয়ে নার্গিস অধ্যায়ের যবনিকা পড়ায় রক্ত ক্ষরণের সৃষ্টি হয়। তখন সেনগুপ্ত পরিবারের মানুষজনের আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসায় নজরুলের হৃদয়ের ক্ষত অনেকটাই নিরাময় হয়। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে তিনি আবার কবিতা ও সঙ্গীত নিয়ে মেতে ওঠেন। বিশেষ করে সেনগুপ্ত পরিবারের কুমারী কন্যা আশালতার অব্যক্ত অনুরাগ তাঁর হৃদয়ে নতুন আশার সঞ্চার করে।
নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন আশালতাকে ছাড়া তার বাঁচার উপায় নেই। অবশেষে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ (২৪ এপ্রিল, ১৯২৪) নজরুল-আশালতা’র বিয়ে হয়। বিবাহিত জীবনে আশালতা হিন্দু এবং মুসলিম দুটি ধর্মই নিজের ইচ্ছে মতো পালন করেছেন।। ধর্মান্তরিত যাতে না হতে হয়, তাই বিশেষ বিবাহ আইন মেনে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। আশালতা দেবী সকালে উঠে যেমন তুলসী তলায় তুলসী মন্ত্র জপেছেন, তেমনই পড়েছেন নামাজ। তাঁর হাতে ছিল শাঁখা পলা, সিঁথিতে সিঁদুর। এমনকি মৃত্যুর পরেও দুই ধর্ম মেনেই সৎকার হয়েছিল আশালতা দেবীর।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের আগে আশালতার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরার মতো উপসর্গ দেখা দিল। ডা. বিধান চন্দ্র রায়, ডা. নরেন ব্রহ্মচারীসহ অনেক বিখ্যাত চিকিৎসকের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এক পর্যায়ে আশালতার দেহের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেল। আশালতার চিকিৎসার জন্য নজরুল চার হাজার টাকায় নিজের সকল বইয়ের মেধাসত্ত্ব একআইনজীবীর কাছে বন্ধক রাখলেন। স্ত্রীর প্রতি অসামান্য ভালোবাসায় ব্যাকুল নজরুল আশালতার রোগ নিরাময়ের জন্য পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন। এমনকি ভূত প্রেত গুণিনেও চেষ্টা করলেন। একবার এক তান্ত্রিক নজরুলকে উপায় বাতলে দিলেন। তিনি বললেন, আশালতাকে সুস্থ করতে হলে বীরভূমের আমোদপুরের সবচেয়ে পুরনো কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গলা জলে নেমে পুকুরের তলদেশের মাটি এনে আশালতার পায়ে লাগালেই সুস্থ হতে পারে। নজরুল তাই করেছিলেন তাঁর জীবন-সঙ্গিনীর জন্য। তবে ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতায় আকাশবাণীর এক অনুষ্ঠান করার সময় নজরুলের কন্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যবার উপক্রম হলো। ধীরে ধীরে বিদ্রোহী কবি কথা বলার ক্ষমতা হারালেন এবং স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি লোপ পেল।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন আশালতা দেবী টালা পার্কের ভাড়া বাড়িতে প্রয়াত হন।পক্ষাঘাতগ্রস্ত আশালতা দেবী যত দিন বেঁচে ছিলেন, শুয়ে শুয়েই অসুস্থ নজরুলের সেবা-যত্ন করেছেন। আশালতা দেবী খাটের স্ট্যান্ডের সাথে বঁটি বেঁধে রাখতেন। শুয়ে শুয়েই যাতে নজরুলের প্রিয় সবজিগুলো কাটার বন্দোবস্ত করা যায়। বিছানায় থেকেই কাৎ হয়ে স্টোভে নজরুলের প্রিয় তরকারি রান্না করতেন।। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধি আশালতা গভীর নজরুল প্রেমে আচ্ছন্ন ছিলেন। একবার পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী খেতে দিয়েছেন নজরুলকে। কিন্তু কিছুতেই তিনি খেতে বসছেন না নজরুল। অবশেষে আশালতা দেবী বললেন, কবির প্রিয় আসনটি পেতে দেওয়া হয়নি। হ্যাঁ, কবিকে ভালবেসে এভাবেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন আশালতা সেনগুপ্ত।
কলমে – মহম্মদ সাইফুল ইসলাম
Discussion about this post