কথায় আছে যুদ্ধক্ষেত্র আর প্রেমে সব নিয়মই নাকি চলে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় একথাটাই বোধহয় বেদবাক্য ভেবেছিল এক বিদেশী তরুণ। সেই ছেলেটির কান্ড যদি শোনেন তাহলে তাকে ৭১-এর রবিনহুড বললেও অবাক হবেন না। এই রবিনহুডের বাড়ি ছিল বেলজিয়ামে, নাম মারিও রয়ম্যান্স। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা তাকে নাড়া দিয়েছিল। একেই বোধহয় মানবতা বলে, যখন দেশ-সীমানার গন্ডি পেরিয়ে মানুষ শুধু মানুষের কথা ভাবে।
১৯৭১ সালে মারিও পিয়ের রয়ম্যান্স ছিলেন ২১ বছরের এক তরুণ। তখন বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার,গণহত্যা,ধর্ষন, শরণার্থী শিবিরের দুর্বিষহ জীবনের খবর কখনও কখনও টেলিভিশনে দেখা যেত। বাংলাদেশের মানুষের ওপর চলা পাকিস্তানি বর্বরতার খুব সামান্য অংশই তাতে দেখা যেত। কিন্তু সেই দৃশ্যই দেখে রয়ম্যান্সের মনে হয়েছিল এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য করার মতো আর্থিক সঙ্গতি রয়ম্যান্সের নিজেরও ছিলনা।সে ছিল হোটেলের সামান্য একজন ওয়েটার। তখন তিনি ভাবেন যে কোনো পথেই হোক টাকা জোগাড় করে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। মানবতার স্বার্থে শেষপর্যন্ত চুরি করলেন বেলজিয়ামের এই তরুণ।
মারিও রয়ম্যান্স ছিল চিত্রকর্মের ভক্ত। ১৯৭১-এর ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের ফাইন আর্ট প্যালেসে এক চিত্রপ্রদর্শনী চলছিল, প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘ইউরোপ অ্যন্ড ইটস্ টাইম’। এখানে নানা দুর্মূল্য ছবির মধ্যে অন্যতম ছিল ডাচ চিত্রশিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’, যার বাংলা তর্জমা করলে হয় ‘প্রেমপত্র’।সেই সময় যার মূল্য ছিল প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার। রয়ম্যান্সের চোখ পড়ল সেদিকেই। প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে ফাঁকতালে লুকিয়ে পড়েন হলের কোণে একটি ইলেকট্রিকাল বাক্সের ভেতর।রাতে প্রর্দশনী বন্ধ হওয়ার পর সে বাক্স থেকে বেরিয়ে ছবিটি নামায়। হলের জানলা দিয়ে পালাতে গিয়ে দেখেন ছবিটির ফ্রেম অনেক বড়ো হওয়ায় জানলায় আটকে যাচ্ছে। তখন ছুড়ি দিয়ে ফ্রেম কেটে ছবিটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়েই সে চম্পট দিলেন।
যে হোটেলে কাজ করতন, সেই হোটেলেরই একটা ঘরে থাকতেন রয়ম্যান্স। ছবিটি হোটেলের পিছনের বাগানে গর্ত করে পুঁতে রাখেন। কিন্তু কদিন পরে বৃষ্টি শুরু হলে ছবিটি নিয়ে এসে বালিশের নীচে রাখেন। কিন্তু রয়ম্যান্স বুঝলেন এইভাবে লুকিয়ে রেখে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। তখন বেলজিয়ামের ‘ল সয়্যার’ নামের সংবাদপত্রের অফিসে যোগাযোগ করে জানান যে, ‘দ্য লাভ লেটার’ ছবিটি তার কাছে আছে এবং ছবি ফেরত পেতে ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক (৪ মিলিয়ন ডলার) দিতে হবে। সেই টাকা দিতে হবে ‘কারিতন’ নামের ক্যাথলিক চার্চে এবং তারা যেন ওই টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে শরণার্থীদের সাহায্য করে। তিনি নিজের পরিচয় দেন ‘লিমবার্গের থিল’ বলে। থিল হলো একটি লোকগাথার চরিত্র, অনেকটা রবিনহুডের মতো। যে ধনীদের থেকে চুরি করে গরীব লোকের মধ্যে বিলিয়ে দেয়।
তারপর অবশ্য রয়ম্যান্স ধরা পড়ে যায়। বিচারে তার দু’বছরের কারাদন্ড হয়। কিন্তু ততক্ষণে বেলজিয়ামে সে মানবতার অনন্য নজির সৃষ্টি করে ফেলে। বেলজিয়ামের মানুষজন রয়ম্যান্সকে সমর্থন জানাতে থাকে। দু’বছরের সাজা কমে ছয় মাস হয়। তবে যে কারণে রয়ম্যান্সের চুরি করা, সেই বাংলাদেশে বেলজিয়াম থেকে সাহায্য এসেছিল কিনা সেকথা জানা যায় না। এই ছয় মাসের কারাগার যাপনের পরই সে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৯ সালে ২৯ বছর বয়সে মারা যায় বেলজিয়ামের রবিনহুড মারিও পিয়ের রয়ম্যান্স। অচেনা অজানা একটা দেশের মানুষের কষ্টে এমন ব্যথিত হওয়ার নজির বোধহয় দেখা যায়না। রয়ম্যান্স ‘মুক্তিযোদ্ধা’র চেয়ে কম কী!
Discussion about this post