শীত কাটিয়ে বাঙালির জীবনযাত্রায় গরমের আমেজ আসে দোল পূর্ণিমার সাথেই। দোলের আগের দিন ন্যাড়া পোড়া থেকে শুরু করে কোথাও পঞ্চম দোল বা কোথাও বারো দোল পর্যন্ত চলে এই উৎসবের আবহ। নদীয়ার নবদ্বীপে মহা ধূমধামে পালিত হয় পঞ্চম দোল। তবে নবদ্বীপ ছাড়াও মালদহের হরিশচন্দ্রপুর, দুমকার সাদীপুর, বলরামচক, ধানডাঙ্গা, বাংলাদেশের কেঁড়াগাছী সহ বিভিন্ন অঞ্চলের পঞ্চম দোল একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্বণ। তবে এদের মধ্যেই অন্যতম কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় চট্টরাজবাড়ির পঞ্চম দোল উৎসব।
“ফাল্গুনপূর্ণিমা তিথি নক্ষত্র ফাল্গুনী। জনম লভিল গোরা গৌরগুণমণি।।” শ্রী মহাপ্রভুর জন্মতিথি দোল পূর্ণিমা। পরদিন পালিত হয় মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন ৷ তার পরদিন হয় মহাপ্রভুর পাদুকা নিয়ে শোভাযাত্রা ৷ পঞ্চম ও দশম দিনে হয় মহাপ্রভুর দোল ৷ বিভিন্ন মন্দিরের বহু সেবাইতরা মনে করেন রাধাকৃষ্ণের দোলের দিন মহাপ্রভুর দোল হওয়া উচিত নয়৷ তাই পালন করা হয় পঞ্চম দোল৷ প্রচলিত আছে পঞ্চম দোলের সময় শ্রীকৃষ্ণ সখা সখীদের সঙ্গে দোলায় চেপে আনন্দ করতেন। তাই অনেক জায়গায় এদিন পালকীতে চড়িয়ে দেব মূর্তিকে ঘোরানো হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৪২ সালে আলীবর্দী খাঁ যখন উড়িষ্যা অভিযানে ব্যস্ত, তখন মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা আক্রমণ করেন। বর্ধমান লুঠ করতে করতে তিনি কাটোয়া দখল করে নেন। তখন শ্রীখণ্ড থেকে এই বড়া গ্রামেই আশ্রয় নেন চট্টরাজ পরিবার। পরিবারের সদস্য গুরুপদ চট্টরাজ জানান, “বর্গীরা যখন আক্রমণ করে সমস্ত দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে দিচ্ছিলেন। সেই সময় মৌগ্রামের পাশে গঙ্গায় বিগ্রহকে বিসর্জন দিয়ে রাধাদামোদর নারায়ণ শিলাকে পৈতায় বেঁধে রাস্তা হাঁটতে শুরু করেন। অনেক রাস্তা পেরিয়ে বড়া গ্রামে তারা বিশ্রাম নিলেন। সেখানে তিনি স্বপ্নাদেশ পান, “এই গ্রামের উত্তরে একটি নিমগড় বলে পুকুর আছে আর একটি নিমগাছ আছে। সেই নিমগাছের কাঠ থেকে আমার কাঠের বিগ্রহ তৈরি কর। যে মিস্ত্রি তৈরি করবে সে এই গ্রামেরই পূর্বদিকে বসবাস করে। আমার বিগ্রহ কেমন হবে তার ছবি আমি তার মনের মধ্যে দিয়েছি। পরে সবাই মিলে গিয়ে নিম গাছের খোঁজ করে সেই গাছ কেটে একটি খণ্ড দিয়ে এই বিগ্রহ তৈরি হয়।”
কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় চট্টরাজবাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দির প্রায় তিন শতাব্দী প্রাচীন। এত বছর পার করেও, আজও নাটমন্দির থেকেই বিগ্রহ দর্শন করতে হয় ভক্তদের। পারিবারিক মন্দির হওয়ায় মহাপ্রভুর মূল মন্দিরে ওঠার অনুমতি নেই সর্বসাধারণের। ইতিহাসে মোড়া চট্টরাজবাড়ির দোলযাত্রা দেখতে ভিড় জমান কাটোয়া সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহু দর্শনার্থী। কারবালাতলার কাছে তিন রাস্তা সংযোগে ম্যাড়া পোড়ানোর আয়োজন করা হয়। চট্টরাজবাড়ির দোলযাত্রার মূল আকর্ষণ পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দোলের দিন এখানে নাম সঙ্কীর্তনে, ভোগপুজো ও আরতির আয়োজন করা হয়। দুপুরে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। ধনী, দরিদ্র, ধর্মবর্ণ সকল মানুষ নির্বিশেষে প্রসাদ গ্রহণ করেন।
দোল মূলত শ্রীকৃষ্ণের লীলা সমৃদ্ধ হলেও, ঐতিহ্যবাহী কাটোয়ায় দোলের মাহাত্ম্য সারা বঙ্গ খ্যাত। কাটোয়ার ছোট বড় বিভিন্ন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ বিভিন্ন রূপে বিরাজ করেন। সরাধাকান্তদেবের মন্দির, ষড়ভুজা মন্দির, রাধামাধব মন্দির, সখীর আখড়া, আশ্রমে দোল পূর্ণিমার দিন হোলি উৎসব পালিত হয়। বহু মন্দিরে দোলের দিন ভোগপুজোও হয়ে থাকে।
Discussion about this post