সালটা ১৯৮৭। ইতালীয় ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় এক বছর। কারণ সে বছরই প্রথম ইতালীয় লিগ জয়ের অন্যতম দাবীদার হয়ে উঠে এসেছে নাপোলি। ইতালির নেপলস শহরের একমাত্র টিম, নাপোলি। সেই নেপলস শহর, খাবার আর জলের অভাবে যে ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় করে উঠেছিল হাহাকার। আবার আশির দশকের কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম,বেকারত্ব আর ক্যামোরা মাফিয়াদের জন্য নিত্যদিনই খবরের কাগজের মুখরোচক চর্চায় উঠে এসেছিল সেই শহরের নামই। আনন্দ-অবকাশের কোনও উপায়ই যে শহরের কাছে, শেষ মেশ ‘৮৭তে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণই। নেপলসেরই নাপোলির হাত ধরে ঘটল দীর্ঘ ৬০ বছরের প্রতীক্ষার অবসান, প্রথমবার লিগ জয়ের। নাপোলি হল ইতালির সেরা!
দিনটা ছিল ১০ মে। সারা নেপলস স্টেশন জুড়ে সেদিন হাল্কা নীল রঙের পতাকা, স্কার্ফ এবং ব্যানারের ছড়াছড়ি। যেন বিশাল কিছু হতে চলেছে! আর হবে নাই বা কেন! নাপোলি যে সেদিন লিগ জয়ের পথে আর কয়েক পা দূরেই দাঁড়িয়ে। প্রায় প্রতিটা বছর ইতালীয় লিগে অবনমন বাঁচানোর লড়াই করেছে যে দল, তারাই নাকি সেবার লিগ জয়ের অন্যতম দাবীদার! শেষ ম্যাচে নাপোলি সামনে ফিওরেন্তিনা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য জয় না পেলেও চলে। চাই শুধুমাত্র একটা ড্র।
এসব হিসাব মাথায় নিয়েই শুরু হল খেলা। ম্যাচের তখন সবে কিছুক্ষণ গড়িয়েছে। ২৯ মিনিটের মাথায় গোল করলেন কার্নিভেল। উল্লাসে প্রায় ফেটে পড়ল গ্যালারি ভর্তি হাজার হাজার দর্শক। বেশ কিছুটা পর বিপক্ষের দল থেকেও এল গোল। তবে খেলা শেষ হল ড্র-তেই। শেষ বাঁশির বাজার সঙ্গে সঙ্গেই লিগ চ্যাম্পিয়ন নাপোলি! পর দিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় লেখা হল- “নাপোলির উল্লাস মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতের চেয়েও বেশি জোরালো ইতালীয় ফুটবলে!”
কিন্তু অবিশ্বাস্য সাফল্য ঠিক কার জন্য সম্ভব হল? কে তিনি যে নাপোলিতে যোগ দেওয়ার পরের দুবছরের টিকিট বিক্রি, ছাপিয়ে গেছিল আগের ২৪ বছরের মোট টিকিট বিক্রির পরিমাণকেও? তিনি আর কেউ নন, ভিল্লা ফিওরিতোর বস্তি থেকে উঠে আসা দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা-ই। সারা বিশ্ব যাকে চেনে ফুটবলের রাজপুত্র হিসাবেই। সেই তিনিই এলেন ম্যাচের পর। সমর্থক দের দিকে ছুঁড়ে দিলেন উড়ন্ত চুমু। আর বললেন- “এই জয় তোমাদের জন্যই!” নাপোলিকে ফুটবল মানচিত্রে অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ দল হিসাবে তুলে ধরার জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘কিং অফ নেপলস’ও। আজও সেই মারাদোনা-জ্বরেই আক্রান্ত ইতালি।
নেপলস ক্যাথিড্রালে আজও যাঁর রক্ত একটি রুপোলী পাত্রে রাখা, জনপ্রিয়তায় নাপোলির সেই সেন্ট সান জেননারোকেও একসময় কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখে ফেলেছিলেন দিয়েগো। আসলে এটাই ফুটবল। আর ফুটবলের রাজপুত্রের হাত ধরেই খেলার মাঠে জন্ম নিয়েছে একের পর এক রূপকথা। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে তিনি ছড়িয়ে গেছেন তাঁর সেই সাদা বুটজোড়ার জাদু। তিনি বাড়িয়েছেন নস্টালজিয়া। আর তাই, মারা যাওয়ার পরও তিনি লাভ করেছেন অমরত্ব। তাঁর দু পায়ের ফাঁকে এখনও সারা পৃথিবী যেন স্বপ্নে বিভোর…
কলমে সুকান্ত সেনশর্মা, সম্পাদনা মৌসুমী মোদক
Discussion about this post